শিক্ষা বিজ্ঞান

জন ডিউই এর শিক্ষা দর্শন

Contents

জন ডিউই এর শিক্ষা দর্শন

জন ডিউই এর শিক্ষা চিন্তা আধুনিক কালে পৃথিবীর সব দেশেরই শিক্ষা পদ্ধতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে । তাঁর শিক্ষা দর্শন একদিকে যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত , অন্যদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সমতা রেখে তা সংগঠিত । তাঁর শিক্ষা দর্শনের মধ্যে এই দুই উপাদানের সার্থক সমন্বয় আমরা দেখতে পাই । এই কারণে তাঁর শিক্ষা চিন্তা পৃথিবীর সমস্ত দেশেরই শিক্ষার বিকাশকে সহায়তা করেছে । জন ডিউই এর শিক্ষা চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য হল — তিনি যে শুধু তাত্ত্বিক দিকের উপর আলোকপাত করেছেন তাই নয় , পরীক্ষামূলকভাবে তাঁর শিক্ষা চিন্তাকে প্রয়োগ করার চেষ্টাও করেছিলেন । 

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য ( Dewey’s Educational Philosophy and Aim ) 

আধুনিক যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ডিউই শিক্ষাকে এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছেন । জীবন ধারনের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের যেমন প্রয়োজন , সমাজ জীবনের পক্ষে শিক্ষারও প্রয়োজনীয়তা একই রকম । তিনি বলেছেন— “ What nutrition and reproduction are to physiological life , education is to social life . ” শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের উৎকর্ষণ হয় । শিক্ষা ব্যক্তির সেইসব গুণের বিকাশ করবে , যার দ্বারা ব্যক্তি তার পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন করতে পারবে এবং সমাজ জীবনের দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করতে সক্ষম হবে । তিনি বলেছেন— “ Education is development of all those capacities in the individual which will enable him to control his environment and fulfil his responsibilities . ” 

তাঁর ধারণা অনুযায়ী জীবনী শক্তি দুটি বিশেষ স্রোতে প্রবাহিত হয় । একদিকে আছে মানসিক পরিবেশ । বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়া ও মানসিক বৈশিষ্ট্য এই পরিবেশের অন্তর্গত । এই পরিবেশে জীবনী শক্তির ধারা অন্তর্মুখী । অন্যদিকে আর এক পরিবেশ আছে , তা হল সামাজিক পরিবেশ । এই পরিবেশে জীবনী শক্তির প্রবাহ বহির্মুখী । জীবনী শক্তির এই দ্বিমুখী প্রবাহের ফলে যে দুই বিপরীত বলের ( Opposite force ) সৃষ্টি হয় তাদের সার্থক সমন্বয়ের প্রক্রিয়াই হল শিক্ষা । 

ডিউই এর শিক্ষা দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে , আমরা চারটি মূল উপাদানের সন্ধান পাই । তিনি শিক্ষার প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন । তিনি এ সর্ম্পকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন । এগুলি হল— ( ১ ) শিক্ষাই হল বিকাশ ( Education is growth ) ; ( ২ ) শিক্ষাই জীবন ( Education is life ) ( ৩ ) শিক্ষাই হল সামাজিক উৎকর্ষণের উপায় ( Education as means of gaining social efficiency ) ( ৪ ) শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনঃসংগঠনের মাধ্যম ( Education as reconstruction of experience ) । 

ডিউই শিক্ষার চারটি বৈশিষ্ট্যের কথাই বলেছেন । শিক্ষার নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য তিনি স্থির করে দেননি । তিনি মনে করেন , যেহেতু প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ উভয়েই পরিবর্তশীল , সেহেতু শিক্ষার কোন স্থির লক্ষ্য নির্ণয় করা যায় না । কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সর্বকালের জন্য স্থির হতে পারে না । তাঁর ধারণা অনুযায়ী শিক্ষাই জীবন । পরিবর্তনশীল জীবনের উপযোগী শিক্ষার জন্য পরিবর্তনশীল লক্ষ্যই প্রয়োজন । তাই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার লক্ষ্যকেও নতুন করে স্থির করতে হবে । গতানুগতিক কোন নিয়মবাধা পথে শিক্ষা যদি এগিয়ে চলে , তবে তা জীবনধর্মী হতে পারবে না । 

ডিউই এর এই ধারণা থেকে সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না যে , শিক্ষার কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রয়োজন নেই । ডিউই প্রকৃতপক্ষে তাঁর Democracy and Education লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন । তবে সে লক্ষ্য চিরস্থায়ী হবে না । শিক্ষার লক্ষ্য অবশ্য নির্ধারণ করতে হবে , তবে তা বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই করতে হবে । আর সে দায়িত্ব বর্তমানে শিক্ষকের উপর ।

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

পাঠ্যক্রম সম্পর্কে ডিউই এর বক্তব্যের মধ্যে নতুনত্ব আছে । তিনি পাঠ্যক্রমের সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তাঁর মতে পাঠ্যক্রম বলতে শুধুমাত্র পাঠ্য বিষয় বা বইয়ের অন্তর্গত জ্ঞানকে বোঝায় না । বিশেষ নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা বা পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্গত জ্ঞানের মাধ্যমে মানব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয় মাত্র । তার মধ্যে সৃজনাত্মক উপাদান নেই । তাই পাঠ্যক্রম বলতে তিনি শিক্ষার্থীর সকল রকম অভিজ্ঞতাকেই বুঝিয়েছেন । শিশু আত্মসচেতনার মাধ্যমে যেসব কাজ করবে এবং যত অভিজ্ঞতা অর্জন করবে , তাই তার পাঠ্যক্রম । পাঠ্যক্রম বাইরের কোন সংস্থার দ্বারা শিশুর উপর আরোপিত জ্ঞানের সমষ্টি নয় । 

এইজন্য তিনি পাঠ্যক্রমের নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তু ঠিক করে দেননি । তিনি বৃত্তিমূলক কাজ এবং হাতের কাজের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন পাঠ্যক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে । 

এছাড়া , ব্যক্তি জীবনের উন্নতির জন্য নৈতিক এবং ধর্মীয় চেতনাকে জাগ্রত করার কথা তিনি বলেছেন , এবং অনুরূপভাবে পাঠ্যক্রম রচনার কথা বলেছেন । কিন্তু এই ধরনের শিক্ষার জন্য যে পাঠ্যক্রম হবে , তাও অভিজ্ঞতা এবং কর্মভিত্তিক । শুধুমাত্র মৌখিক জ্ঞানের দ্বারা নীতিবোধ জাগালে চলবে না , শিক্ষার্থীকে যথাযোগ্য পরিস্থিতিতে স্থাপন করে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে । শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমকে তার সামাজিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে । সমাজ জীবনে যেসব অভিজ্ঞতার চাহিদা সে অনুভব করবে । তাই দিয়ে রচনা করবে তার নিজের জন্য পাঠ্যক্রম এবং সেটাই হবে তার কাছে আদর্শ পাঠ্যক্রম ।

জন ডিউই এর শিক্ষা পদ্ধতি ( Dewey’s Method of Instruction ) 

ডিউই শিক্ষাকে মনোবিদ্যা সম্মত করারও পক্ষপাতী ছিলেন । তাই তিনি সম্পূর্ণ শিক্ষা দানের পরিকল্পনাকে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের সঙ্গে সমতা রেখে রচনা করার কথা বলেছেন । শিশুর জীবনকে তিনি মানসিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তিনটি পর্যায়ে বা স্তরে ভাগ করেছেন ( এক ) খেলার প্রাধান্য মূলক স্তর ( Play period ) , ( দুই ) স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগের স্তর ( Period of spontaneous attention ) , ( তিন ) মননশীল মনোযোগের স্তর ( Period of reflective attention ) । 

খেলা প্রধান স্তর : 

প্রথম স্তরের সময়কাল হিসেবে তিনি ৪ থেকে ৮ বৎসর বয়সকে নির্দেশ করেছেন । এই স্তরের প্রথম দিকে শিশু পরিবারের ( Home ) মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজের অনুশীলন করে খেলার মাধ্যমে । এর পরে , গৃহ পরিবেশের কাজ ছাড়াও সমাজের অন্যান্য কাজও সে অনুশীলন করতে আরম্ভ করে ; বিশেষভাবে সেইসব কাজের প্রতি তার ঝোঁক দেখা যায় , যেগুলির জন্য তার পরিবারকে সমাজের উপর নির্ভর করতে হয় । অবশেষে , এই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সে অন্যান্য সামাজিক ক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয় । ডিউই বলেছেন , এই স্তরেরই শেষের দিকে শিশুকে সাধারণভাবে লেখা পড়া এবং ভূগোল সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দিতে হবে । 

স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগের স্তর :

দ্বিতীয় স্তরের সময়কালের ঊর্ধ্বসীমা হিসেবে ডিউই ১২ বছর ( ৮-১২ বয়স সীমাকে ) নির্দেশ করেছেন । এই বয়সে শিশুরা লক্ষও এবং উপায় ( Means and ends ) এর মধ্যে পার্থক্য করতে শেখে । এখন তারা জীবনের প্রত্যক্ষ সমস্যা সমাধানের উপযোগী হয়ে ওঠে । এইসময় থেকে তাকে প্রত্যক্ষ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে । বিভিন্ন ধরনের সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে তাকে স্থাপন করে সমস্যা সমাধানের সুযোগ দিতে হবে । এ ছাড়া , এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সমাজবিদ্যা ( Social studies ) পড়ানোর কথা তিনি বলেছেন । কারণ , এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মানব সভ্যতার বিকাশের ধারার সঙ্গে পরিচিত হবে । সে বুঝতে শিখবে , কিভাবে মানুষ তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন পরিস্থিতিকে আয়ত্তে এনেছে । 

মননশীল মনোযোগের স্তর :

১২ বৎসরের পরবর্তীকালকে তিনি মননশীল মনোযোগের স্তর হিসেবে নির্দেশ করেছেন । মননশীল মনোযোগের এই বয়সের পর শিশুরা নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এবং নিজেরাই সমাধান করতে পারে । এই স্তরের শিক্ষা এমন হওয়া দরকার যে , তারপরেই শিক্ষার্থীরা সমাজ জীবন যাপনের উপযোগী হয় । 

সক্রিয়তার নীতি ও সমস্যামূলক শিক্ষণ পদ্ধতি :

ডিউই শিক্ষণ পদ্ধতিকে মনোবিদ্যা সম্মত করে রচনা করতে চেয়েছিলেন । তিনি মনে করতেন , মন হল সক্রিয়তার ফল এবং সক্রিয়তার মাধ্যমেই তার বিকাশ হয় । মনের চিন্তন প্রক্রিয়াকে জাগ্রত করার জন্য উদ্দীপকের প্রয়োজন এবং সেই উদ্দীপক সমস্যা ভিত্তিক না হলে চিন্তন প্রক্রিয়ার পেছনে প্রেষণা থাকতে পারে না । শিক্ষণ পদ্ধতির পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে ডিউই এই তত্ত্বকে প্রয়োগ করেছেন । শিশুর আগ্রহ এবং প্রবণতাকে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষাকে সমস্যাভিত্তিক করতে হবে । তিনি বলেছেন— “ Method means that arrangement of subject – matter which makes it most effective in use . Never is method something outside of the material . ” 

বিষয়বস্তুর এই বিন্যাস ( Arrangement ) সুষ্ঠুভাবে সমস্যার মাধ্যমেই সম্ভব । তাই তিনি সমস্যামূলক বিষয়বস্তু নির্বাচনের কথা বলেছেন । শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহ এবং প্রবণতা অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ নির্বাচন করবে এবং যখনই সে এই ধরনের সমস্যামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে , তখনই সে তার সমাধানের কথা চিন্তা করবে । এই সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সে তথ্য সংগ্রহ করবে এবং পরে সেগুলিকে সমস্যা সমাধানের কাজে লাগাবে । এইভাবে যখন সে সমস্যা সমাধান করতে পারবে , তখন সেই জ্ঞান সে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করবে । এই পদ্ধতিকে ডিউই নাম দিয়েছেন ‘ সমস্যামূলক পদ্ধতি ‘ ( Problem Method ) । পরবর্তীকালে এই পদ্ধতির সংস্কার সাধনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে প্রোজেক্ট পদ্ধতি ( Preject Method ) । 

সমস্যামূলক পদ্ধতির বিভিন্ন স্তর :

ডিউই এর এই পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা পাঁচটি সোপান বা স্তর দেখতে পাই । তিনি বলেছেন , এই সমস্যা পদ্ধতিতে পাঁচটি স্তর অবশ্যই থাকা প্রয়োজন এবং এর প্রত্যেক স্তরে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ এই পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্য । এই পাঁচটি স্তর হল— 

( ১ ) সমস্যা সৃষ্টি : প্রথম স্তরে শিক্ষার্থী পরিস্থিতিকে এমনভাবে সাজাবে যাতে করে একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় । অর্থাৎ , শিক্ষার্থীকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে তার প্রবণতা অনুযায়ী । কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে যখনই সে বাধার সম্মুখীন হবে , তখনই সমস্যার সৃষ্টি হবে । তাই সমস্যা সৃষ্টি করা শিক্ষার্থীর নিজেরই কাজ । 

( ২ ) সম্ভাব্য সমাধান নির্ধারণ : এই ধরনের সমস্যামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে শিক্ষার্থী তা সমাধানের জন্য বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে চিন্তা করতে আরম্ভ করবে । এটাই হল দ্বিতীয় স্তর । এখানেও শিক্ষার্থী মানসিক স্তরে বিশেষভাবে সক্রিয় হবে । অর্থাৎ , সমস্যা সমাধানের জন্য সম্ভাব্য কতকগুলি প্রকল্প গঠন এই স্তরের কাজ । 

( ৩ ) তথ্য সংগ্ৰহ : পরবর্তী স্তরে সে তার চিন্তা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা তথ্য সংগ্রহে অগ্রসর  হবে । কোন বিশেষ সমস্যা সমাধানের জন্য তার যে সব হাতিয়ার বা তথ্যের প্রয়োজন , তা সে সমাজ পরিবেশের মধ্যে সংগ্রহ করবে । 

( 8 ) সম্পাদনের সক্রিয়তা : এর পর চতুর্থ স্তরে সে সমস্যা সমাধানের জন্য কর্ম সম্পাদন করবে । তার চিন্তালব্ধ পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়ে সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থী সমস্যার প্রকৃত সমাধান করবে ।   

( ৫ ) প্রয়োগ : সবশেষে , সে বিশেষ সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করল , তা নতুন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে তার যাথার্থ্যতা বিচার করবে , তবেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে ।

ডিউই এর শিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিকভাবে কাজ করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । শিক্ষার্থীরা সমবেত চেষ্টায় বিশেষ কোন সমস্যার সমাধান করে । এই সমবেতভাবে কাজ করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সামাজিক মনোভাবের বিকাশ হয় । ফলে , ডিউই এর এই শিক্ষণ পদ্ধতি তাঁর শিক্ষার দ্বিমুখী উদ্দেশ্যের অনুকূল ।

জন ডিউই এর মতে শিক্ষকের ভূমিকা ( Dewey’s Method of Instruction and Teachers ) 

ডিউই এর শিক্ষণ পদ্ধতিতে বলা হয়েছে , শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রত্যেক স্তরেই সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করবে । সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী , শিক্ষক বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন , তিনি পরিকল্পনা রচনা করেন , তিনিই পাঠদান করেন এবং সবশেষে ছাত্রদের জ্ঞান প্রয়োগ করার সুযোগ দেন । কিন্তু ডিউই এর পদ্ধতিতে এই প্রত্যেকটি পর্যায়েই শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে । 

শিক্ষকের নতুন ভূমিকা ও দায়িত্ব :

সুতরাং ডিউই বলেছেন , শিক্ষক এখানে শিক্ষার্থীকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করবেন । তবে তিনি পরোক্ষভাবে পাঠের সব পর্যায়েই অংশগ্রহণ করবেন । তাঁর দায়িত্ব গতানুগতিক পাঠদানের দায়িত্বের চেয়ে অনেক বেশী । শিক্ষার্থীরা যখন সমস্যা নির্ধারণ করবে , তখন তিনি পরোক্ষভাবে তাঁদের উপর প্রভাব বিস্তার করবেন । তার কারণ , সমস্যা যাতে শিক্ষার্থীর মানসিক ক্ষমতার উপযুক্ত হয় , সে দিকে  লক্ষ্য রাখতে হবে । 

তাই তিনি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানসিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে , তাদের বিষয় নির্বাচনে সহায়তা করবেন । কোন শিক্ষার্থী যে বিশেষ সমস্যা নির্বাচন করেছে , তা সে যেন তার মানসিক ক্ষমতার দ্বারা সমাধান করতে সক্ষম হয় , এ বিষয়ে তিনি সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবেন । এছাড়া , সমস্যাগুলি যাতে জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হয় , সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন । অর্থাৎ , এক কথায় শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু , সহায়ক এবং যোগ্য নির্দেশকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন ।

জন ডিউই এর শিক্ষালয় সম্পর্কে ধারণা ( Dewey’s concept of School ) 

গবেষণামূলক বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ডিউই তাঁর শিক্ষা চিন্তাকে প্রত্যক্ষ রূপ দেওয়ার জন্য ১৮৬৯ সালে শিকাগোতে এক বিদ্যালয় স্থাপন করেন । এই বিদ্যালয় গবেষণামূলক বিদ্যালয় ( Laboratory of Experimental School ) নামে পরিচিত । এখানে ডিউই তাঁর শিক্ষাতত্ত্বকে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করে যাচাই করে দেখেন । এই বিদ্যালয়ে গতানুগতিক কোন উপকরণ ছিল না । এমন কি , তিনি এখানে কোন নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী পাঠ পরিচালনার ব্যবস্থা করেননি । 

গবেষণামূলক বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য :

এখানে শিক্ষার্থীরা নিজের ইচ্ছানুযায়ী সমস্যা নির্বাচন করত । সব শিক্ষার্থীকে একটি সমাজেরই অর্ন্তভুক্ত করা হত । আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক সামাজিক নিয়মে বিষয় নির্বাচনের পর শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে তার সমাধানে অগ্রসর হত । শিক্ষক তাদের সহায়করূপে কাজ করতেন । শিক্ষার্থীদের সমস্যা হিসাবে হাতের কাজ , বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক খেলা দেওয়া হত । এছাড়া , নানা ধরনের বাস্তব সমস্যাও দেওয়া হত যার সমাধানের জন্য তাদের বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হত । এমনিভাবে বিভিন্ন কাজের বা সমস্যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এই গবেষণামূলক বিদ্যালয়ে শিক্ষা করত । প্রত্যক্ষভাবে সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । ডিউই নিজে এই বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন— “ In intent whatever the failure is accomplishment , the school was Community – centred . ” 

শিক্ষালয় সম্পর্কে ধারণা :

শিক্ষালয় সম্পর্কে তাঁর যে মতবাদ , তার পরিপূর্ণ প্রয়োগ আমরা এই বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখতে পাই । তিনি এই বিদ্যালয়কে দ্বিমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন । তিনি গতানুগতিক বিদ্যালয় পরিচালনার পদ্ধতির বিরুদ্ধে বিশেষভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন । তাঁর মতে , ঊনবিংশ শতাব্দীতে সমাজ জীবনে যে পরিবর্তন হয়েছে , বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে , তার সঙ্গে সমতা রক্ষা করতে হলে শিক্ষালয়ের পুনর্গঠন প্রয়োজন । সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি জীবনকে এই ধরনের পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সার্থকভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্য সাহায্য করতে হলে শিক্ষালয় সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণাকে পরিবর্তন করতে হবে । 

এইজন্য তিনি বলেছেন , বিদ্যালয়কে সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে । তবে সমাজের সব কিছু গুণই তার মধ্যে থাকবে না , ভাল অংশগুলিই থাকবে । তিনি একে তাই Purified , Simplified and better balanced society ‘ বলেছেন । সমাজ জীবনের মাধ্যমেই সামাজিক বিকাশ সম্ভব । তাই তিনি তাঁর গবেষণামূলক বিদ্যালয়কে এই আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন । সেখানে শিক্ষার্থীরা সমাজজীবনের মধ্যে বসবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চারিত্রিক গুণের চর্চা করত । 

ডিউই এর পরিকল্পনার মধ্যে নীতিগত কোন বিশেষ ত্রুটি ছিল না । কিন্তু তার প্রয়োগমূলক নানা রকম অসুবিধা এই গবেষণামূলক বিদ্যালয়ে লক্ষ্য করা গেল । তাই তার অনুগামীরা পরবর্তীকালে ডিউই এর শিক্ষানীতির কিছু পরিবর্তনের কথা যা বললেন , বিশেষভাবে তা তার পদ্ধতিরই পরিবর্তনের কথা । 

আলোচনা 

জন ডিউই এর শিক্ষা চিন্তার মধ্যে আমরা তাঁর চিন্তাশীল মনের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই । তাঁর শিক্ষা চিন্তা আধুনিক আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে বিভিন্ন দিক থেকে , সেই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে । 

আধুনিক শিক্ষার যে সব বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই , তার সবকিছু পুনরাবৃত্তির ফলে করার জন্য উপাদানই ডিউই এর শিক্ষা চিন্তার মধ্যে বর্তমান । বহু শতাব্দী ধরে রুশো , পেস্তালাসী , ফ্রয়েবেল , হার্বার্ট প্রভৃতি চিন্তাবিদরা প্রচেষ্টা করে গিয়েছিলেন , ডিউই সেই শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে জড়তা মুক্ত করেছেন । 

শিক্ষাকে বিংশ শতাব্দীর মানব মনের উপযোগী করে গড়ে তোলার সার্থক নির্দেশ দিয়েছেন ডিউই । তাঁর প্রগতিধর্মী শিক্ষা চিন্তা এবং জীবনাদর্শ শিক্ষার সম্পূর্ণ অঙ্গেই নতুনত্বের ছোঁয়া দিয়ে গেছে । তাই ডিউকেই শিক্ষার আধুনিক ভাবধারার প্রতীক বলা যায় । তাঁর বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সারসংক্ষেপ করলে তাঁর অবদানের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারা যায় । 

[ এক ] শিক্ষার নতুন তাৎপর্য : তিনি শিক্ষকদের সামনে শিক্ষার এক নতুন তাৎপর্য তুলে ধরেছেন । শিক্ষা এবং জীবন পৃথক নয় । শিক্ষাই জীবন ; শিক্ষার এই তাৎপর্য আধুনিক কালে শিক্ষাজগতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে সর্বজন সমর্থিত । 

[ দুই ] সক্রিয়তা ভিত্তিক পাঠ্যক্রম : পাঠ্যক্রম রচনার ব্যাপারেও তিনি যে নতুন ধারণার পরিচয় দিয়েছেন , তা আধুনিককালে শিক্ষাক্ষেত্রে সমর্থিত হয়েছে এবং ঐ নীতিকে মেনে নেওয়া হয়েছে । তিনি পাঠ্যক্রমকে শুধু পাঠ্যবিষয় বলেননি । জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে পাঠ্যক্রম বলে বর্ণনা করেছেন । তিনি কর্মভিত্তিক পাঠ্যক্রম ( Activity Curriculum ) রচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন ।  

[ তিন ] সমস্যামূলক পদ্ধতি : ডিউই এর পদ্ধতির মধ্যে অভিনবত্ব আছে । তিনি শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে একদিকে যেমন মনোবিদ্যাসম্মত করার চেষ্টা করেছেন , শিক্ষার্থীর প্রবণতা , আগ্রহ এবং মানসিক ক্ষমতাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে , তেমনি অন্যদিকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন । তাঁর সমস্যা ভিত্তিক পদ্ধতিতে ( Problem Method ) তিনি সমস্যার মাধ্যমে একদিকে শিশুর আগ্রহকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছেন , অন্যদিকে সমাজ জীবনের সঙ্গে তার সার্থক যোগাযোগ স্থাপন করেছেন ।  

[ চার ] ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় : ডিউই তাঁর শিক্ষা তত্ত্বে পরস্পর বিরোধী দুই মতবাদের সার্থক সমন্বয় করেছেন । বিভিন্ন চিন্তাবিদ বিভিন্ন যুগে ব্যক্তিতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের যে কোন একটিকে সমর্থন করে গেছেন । কিন্তু ডিউই বলেছেন , শিক্ষা ব্যক্তির সমাজ জীবনের মধ্যে সক্রিয়তার মধ্যে সংঘটিত হবে । তিনিই প্রথম এই দুই পরস্পর বিরোধী মতবাদের মধ্যে সার্থক সমন্বয় করেছেন । এই সমন্বয়ী চিন্তাধারা আধুনিক শিক্ষার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য । 

[ পাঁচ ] গণতান্ত্রিক আদর্শ : জন ডিউই শিক্ষা ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা করেছেন । গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল সহযোগিতামূলক মনোভাব । তাঁর গবেষণামূলক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতায় সমস্যা সমাধানে নিজেদের নিয়োগ করত । এছাড়া , তিনি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আদর্শ স্থাপনের জন্য ধর্মীয় , সামাজিক , সকল রকম বিভেদের রেখাকে মুছে ফেলার হাতিয়ার হিসাবে শিক্ষাকে ব্যবহার করতে  বলেছেন । 

[ ছয় ] শৃঙ্খলার ধারণা : তাঁর শিক্ষা পরিচালনার জন্য বিদ্যালেয়ে যে শৃঙ্খলার কথা তিনি বলেছেন , তা শৃঙ্খলার আধুনিক ধারণার মতই । তিনি বলেছেন , শিশুরা নিজের আগ্রহেই কাজ করবে , সুতরাং তার মধ্যে বিশৃঙ্খলতার কোন সুযোগ থাকবে না । তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা স্থাপন করবে ।

[ সাত ] শিক্ষকের দায়িত্ব : শিক্ষক সম্পর্কে তার ধারণাও আধুনিক চিন্তাধারার অনুরূপ । শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু এবং নির্দেশক । 

মন্তব্য 

সমস্ত দিক দিয়ে বিবেচনা করে বলা যায় জন ডিউই শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন । শিক্ষার আধুনিক ভাবধারা , যার মূল বৈশিষ্ট্য হল সমন্বয় সাধন ( Eclecticism ) , জন ডিউই তার সূত্রপাত করেছেন । তাঁর শিক্ষা চিন্তার মধ্যে আমরা জীবনের সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয় , পদ্ধতির সঙ্গে লক্ষ্যের সমন্বয় , ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সমন্বয় , এতগুলি সমন্বয় দেখতে পাই । তাই তাঁরাই এই প্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে আধুনিক শিক্ষার নবধারার প্রবর্তন হয়েছে । এরও হয়ত পরিবর্তন হবে ; নিশ্চয়ই হবে , ডিউইও তা বিশ্বাস করেন । কিন্তু ডিউই এর অবদান শিক্ষা ক্ষেত্রে চিরকাল স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবে । তাই রাস্কের ( Rusk ) একটি সুন্দর উক্তি উদ্ধৃত করে আমরা এই আলোচনা শেষ করছি । “ In education we cannot but be grateful to John Dewey for his great services in challenging the old static cold storage ideal of knowledge and in bringing education more into accord with actualities of present day life . ” 

আরো পড়ুন : জন ডিউই এর শিক্ষা দর্শন

জন ডিউই এর শিক্ষা পদ্ধতি

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

error: Content is protected !!