শিক্ষা বিজ্ঞান

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

জন ডিউই এর শিক্ষা চিন্তা আধুনিক কালে পৃথিবীর সব দেশেরই শিক্ষা পদ্ধতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে । তাঁর শিক্ষা দর্শন একদিকে যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত , অন্যদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সমতা রেখে তা সংগঠিত । তাঁর শিক্ষা দর্শনের মধ্যে এই দুই উপাদানের সার্থক সমন্বয় আমরা দেখতে পাই । 

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য

আধুনিক যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সমতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ডিউই শিক্ষাকে এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছেন । জীবন ধারনের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের যেমন প্রয়োজন , সমাজ জীবনের পক্ষে শিক্ষারও প্রয়োজনীয়তা একই রকম । তিনি বলেছেন— “ What nutrition and reproduction are to physiological life , education is to social life . ” শিক্ষার দ্বারা ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের উৎকর্ষণ হয় । শিক্ষা ব্যক্তির সেইসব গুণের বিকাশ করবে , যার দ্বারা ব্যক্তি তার পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন করতে পারবে এবং সমাজ জীবনের দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করতে সক্ষম হবে । তিনি বলেছেন— “ Education is development of all those capacities in the individual which will enable him to control his environment and fulfil his responsibilities . ” 

তাঁর ধারণা অনুযায়ী জীবনী শক্তি দুটি বিশেষ স্রোতে প্রবাহিত হয় । একদিকে আছে মানসিক পরিবেশ । বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়া ও মানসিক বৈশিষ্ট্য এই পরিবেশের অন্তর্গত । এই পরিবেশে জীবনী শক্তির ধারা অন্তর্মুখী । অন্যদিকে আর এক পরিবেশ আছে , তা হল সামাজিক পরিবেশ । এই পরিবেশে জীবনী শক্তির প্রবাহ বহির্মুখী । জীবনী শক্তির এই দ্বিমুখী প্রবাহের ফলে যে দুই বিপরীত বলের ( Opposite force ) সৃষ্টি হয় তাদের সার্থক সমন্বয়ের প্রক্রিয়াই হল শিক্ষা । 

ডিউই এর শিক্ষা দর্শনকে বিশ্লেষণ করলে , আমরা চারটি মূল উপাদানের সন্ধান পাই । তিনি শিক্ষার প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন । তিনি এ সর্ম্পকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন । এগুলি হল— ( ১ ) শিক্ষাই হল বিকাশ ( Education is growth ) ; ( ২ ) শিক্ষাই জীবন ( Education is life ) ( ৩ ) শিক্ষাই হল সামাজিক উৎকর্ষণের উপায় ( Education as means of gaining social efficiency ) ( ৪ ) শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনঃসংগঠনের মাধ্যম ( Education as reconstruction of experience ) । 

ডিউই বিশ্বাস করেন , জীবনের ধর্ম হল বিকাশ , আর সেই বিকাশের কোন শেষ নেই । শিক্ষার কাজ হল সেই বিকাশে সহায়তা করা । এই বিকাশের কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নেই । বিকাশ অভিমুখতাই যেমন এই বিকাশের মূল কথা ; তেমনি শিক্ষা অভিমুখিতাই শিক্ষার মূল ধর্ম । শিক্ষার্থীর মানসিক বৈশিষ্ট্যের পরিপক্কতার মাধ্যমে শিক্ষা তার মধ্যে জীবনব্যাপী জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তুলবে । 

ডিউই এর শিক্ষা দর্শনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল — তিনি শিক্ষা এবং জীবনকে পৃথকভাবে দেখেননি । শিক্ষাকে তিনি জীবনোপযোগী করে গড়ে তোলার কৌশল হিসাবে গ্রহণ করেননি । শিক্ষাই তাঁর কাছে জীবন ( Education is ife itself ) । তিনি বলেছেন— “ Life is a byproduct of activities and education is born out of these activities . ” শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী প্রকৃত জীবন সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হবে এবং এই সমস্যা সমাধানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের শিক্ষা হবে । এইজন্য তিনি শিক্ষালয়ের জীবনের সঙ্গে সমাজ জীবনের সম্পর্ক স্থাপন করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন । শিক্ষালয়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রত্যক্ষ পরিস্থিতিতে নির্ভীকভাবে গ্রহণ করতে এবং তাঁর সমাধান করতে শেখাতে হবে । 

শিক্ষার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীর সামাজিক সক্ষমতা ( Social efficiency ) বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন । তিনি বলেছেন মানুষ সামাজিক জীব এবং সে সব সময় জীবন বিকাশের জন্য সমাজ থেকে শক্তি সঞ্চয় করছে । সমাজ থেকে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করছে । সমাজ চেতনার মাধ্যমেই তার রুচি , ভাষা অভ্যাস এবং সকল রকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হয় । শিক্ষার কাজ হবে অসামাজিক , অপরিপক্ক শিশুকে সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা । এই দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয় শিক্ষা হল এক ধরনের সামাজিক প্রক্রিয়া এবং সামাজিক সক্ষমতার ( Social efficiency ) বিকাশই হল শিক্ষার উদ্দেশ্য । 

সবশেষে , ডিউই বলেছেন , শিক্ষা হল অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনের মাধ্যমে সমাজ জীবনের বিকাশের প্রক্রিয়া । তিনি বলেছেন— “ We should so regulate the learning and experiencing activities of the young that a newer and better society will arise in the end . ” প্রত্যেক অভিজ্ঞতাই ব্যক্তিকে নতুন অভিজ্ঞতামুখী করে তোলে এবং প্রত্যেক নতুন অভিজ্ঞতা অতীত অভিজ্ঞতার পরিবর্ধন ও পরিমার্জনে সহায়তা করে । জীবন এবং শিক্ষা অবিচ্ছিন্নধর্মী আর প্রত্যেক অভিজ্ঞতাই এই অবিচ্ছিন্ন বহমানতাকে বজায় রাখতে সহায়তা করে । 

জীবন হল জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার স্রোতে ভেসে যাওয়া জীবনী শক্তির প্রকাশ মাত্র । ব্যক্তির জীবন বিকাশের জন্য তাই প্রয়োজন অবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার ধারা । শিক্ষার্থীকে অবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিয়ে তার দৈহিক , মানসিক , সামাজিক এবং নৈতিক জীবনের বিকাশে সহয়তা করতে হবে । কেবলমাত্র শিক্ষাই সে কাজ করতে পারে । অর্থাৎ , তাঁর মতে শিক্ষা হল এক ধরনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসংযোজন সাধিত হয় । 

ডিউই শিক্ষার চারটি বৈশিষ্ট্যের কথাই বলেছেন । শিক্ষার নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য তিনি স্থির করে দেননি । তিনি মনে করেন , যেহেতু প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ উভয়েই পরিবর্তশীল , সেহেতু শিক্ষার কোন স্থির লক্ষ্য নির্ণয় করা যায় না । কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সর্বকালের জন্য স্থির হতে পারে না । তাঁর ধারণা অনুযায়ী শিক্ষাই জীবন । পরিবর্তনশীল জীবনের উপযোগী শিক্ষার জন্য পরিবর্তনশীল লক্ষ্যই প্রয়োজন । তাই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার লক্ষ্যকেও নতুন করে স্থির করতে হবে । গতানুগতিক কোন নিয়মবাধা পথে শিক্ষা যদি এগিয়ে চলে , তবে তা জীবনধর্মী হতে পারবে না । 

ডিউই এর এই ধারণা থেকে সিদ্ধান্ত করা ঠিক হবে না যে , শিক্ষার কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রয়োজন নেই । ডিউই প্রকৃতপক্ষে তাঁর Democracy and Education লক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন । তবে সে লক্ষ্য চিরস্থায়ী হবে না । শিক্ষার লক্ষ্য অবশ্য নির্ধারণ করতে হবে , তবে তা বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই করতে হবে । আর সে দায়িত্ব বর্তমানে শিক্ষকের উপর ।

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

পাঠ্যক্রম সম্পর্কে ডিউই এর বক্তব্যের মধ্যে নতুনত্ব আছে । তিনি পাঠ্যক্রমের সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তাঁর মতে পাঠ্যক্রম বলতে শুধুমাত্র পাঠ্য বিষয় বা বইয়ের অন্তর্গত জ্ঞানকে বোঝায় না । বিশেষ নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা বা পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্গত জ্ঞানের মাধ্যমে মানব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয় মাত্র । তার মধ্যে সৃজনাত্মক উপাদান নেই । তাই পাঠ্যক্রম বলতে তিনি শিক্ষার্থীর সকল রকম অভিজ্ঞতাকেই বুঝিয়েছেন । শিশু আত্মসচেতনার মাধ্যমে যেসব কাজ করবে এবং যত অভিজ্ঞতা অর্জন করবে , তাই তার পাঠ্যক্রম । পাঠ্যক্রম বাইরের কোন সংস্থার দ্বারা শিশুর উপর আরোপিত জ্ঞানের সমষ্টি নয় । 

এইজন্য তিনি পাঠ্যক্রমের নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তু ঠিক করে দেননি । শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের আগ্রহ – প্রবণতা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের পাঠ্যক্রম রচনা করবে । তাঁর মতে পাঠ্যক্রমের মধ্যে এমন সব সমস্যা থাকবে , যার সম্পাদন ও সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন ও পুনঃসংযোজন করতে সক্ষম হবে । এইজন্য তিনি বৃত্তিমূলক কাজ এবং হাতের কাজের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন পাঠ্যক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে । 

এছাড়া , ব্যক্তি জীবনের উন্নতির জন্য নৈতিক এবং ধর্মীয় চেতনাকে জাগ্রত করার কথা তিনি বলেছেন , এবং অনুরূপভাবে পাঠ্যক্রম রচনার কথা বলেছেন । কিন্তু এই ধরনের শিক্ষার জন্য যে পাঠ্যক্রম হবে , তাও অভিজ্ঞতা এবং কর্মভিত্তিক । শুধুমাত্র মৌখিক জ্ঞানের দ্বারা নীতিবোধ জাগালে চলবে না , শিক্ষার্থীকে যথাযোগ্য পরিস্থিতিতে স্থাপন করে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে । শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমকে তার সামাজিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে । সমাজ জীবনে যেসব অভিজ্ঞতার চাহিদা সে অনুভব করবে । তাই দিয়ে রচনা করবে তার নিজের জন্য পাঠ্যক্রম এবং সেটাই হবে তার কাছে আদর্শ পাঠ্যক্রম । 

তিনি বিশ্বাস করেন , “ Purposeful activity and a curriculum comprising standard factors of social life would give the children more interest and insight , through the functioning of intelligence and will , in the achievement of self control and the appreciation of social values . ” শিশুর সামাজিক চাহিদা এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য উভয়ের উপর সমান গুরুত্ব দিতে হবে তার পাঠ্যক্রম রচনার সময় এবং তা সম্ভব কেবলমাত্র উদ্দেশ্যমুখী কর্মের মাধ্যমে যদি পাঠ্যক্রম রচনা করা যায় । কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং কর্মকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রম ( Activity curriculum ) রচনা করার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন ।

আরো পড়ুন : জন ডিউই এর শিক্ষা দর্শন

জন ডিউই এর শিক্ষা পদ্ধতি

জন ডিউই এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম

error: Content is protected !!