শিক্ষা বিজ্ঞান

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

যে সব শিক্ষাবিদরা শিক্ষার লক্ষ্য সর্ম্পকে আলোচনা করেছেন , তাঁরা প্রত্যেকেই পাঠ্যক্রম ( Curriculum ) সম্বন্ধেও তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন । বার্ট্রান্ড রাসেলও এঁদের ব্যতিক্রম নন । কারণ , শিক্ষার লক্ষ্যগুলিতে উপনীত হতে হলে উপযুক্ত পাঠ্যক্রম এর প্রয়োজন । পাঠ্যক্রম সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই রাসেল বলেছেন , কিছু অভিজ্ঞতা আছে , যা প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তির অর্জন করা প্রয়োজন ; আবার কিছু অভিজ্ঞতা আছে , যেগুলি সকলের অর্জন না করলেও চলে । এই কারণে , রাসেল বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যক্রমকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করার প্রস্তাব করেছেন । 

প্রথমত : 14 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যক্রম এবং 

দ্বিতীয়ত : 15 থেকে 18 বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যক্রম । তিনি বলেছেন 14 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার পাঠ্যক্রমে সেইসব অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে , যেগুলি সব মানুষের জানার প্রয়োজন , অর্থাৎ এই পর্যায়ের পাঠ্যক্রমটি হবে আবশ্যিক । এই পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন । এই বিষয়গুলি হল ভাষা ( Language ) , গণিত ( Arithmethic ) , ইতিহাস ( History ) , ভূগোল ( Geography ) , নাচ ( Dancing ) ও গান ( Singing ) । 

তবে রাসেল , পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত ঐসব বিষয়ের পাঠ্যসূচী ( Syllabus ) নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত রীতি অনুসরণ করার কথা বলেছেন । পাঠ্যসূচী নির্ণয়ের সময় তিনি দুটি মৌলিক নীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন । 

প্রথমতঃ প্রত্যেকটি পাঠ্যাংশকে তাদের কাঠিন্যমানের ( Difficulty value ) পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যসূচীর মধ্যে বিন্যাস করতে হবে । 

দ্বিতীয়তঃ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতাকে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন করতে হবে । উদাহরণ স্বরূপ তিনি উল্লেখ করেছেন গতানুগতিক ভূগোল পাঠের কোন বৌদ্ধিক মূল্য নেই । কিন্তু , ভূগোলের তথ্যগুলি যদি কোন পরিব্রাজকের ( Traveller ) বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক হয় , তাহলে তা শিক্ষার্থীদের কল্পনা শক্তি বিকাশে সহায়তা করে । 

রাসেল যদিও শিশুর 14 বছর পর্যন্ত শিক্ষার জন্য পূর্বোক্ত পাঠ্যক্রমটি নির্দেশ করেছেন , তবুও প্রসঙ্গক্রমে তিনি উল্লেখ করেছেন যে 5 বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য কোন নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম থাকা উচিত নয় । সাধারণ জীবন যাপনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গীত , নৃত্য , গণনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাদানের চেষ্টা করা উচিত । 

দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ , 15 থেকে 18 বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যক্রম নির্ধারণের ব্যাপারে তিনি কতকগুলি নীতি অনুসরণ করার কথা বলেছেন । এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের তিনি দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন — সাধারণের চেয়ে উন্নতমানের বুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানের তুলনায় কম বুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষার্থী । তিনি বলেছেন , সাধারণের তুলনায় উন্নত বুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা এই স্তরে বিশেষধর্মী পাঠ্যক্রম ( Specialized curriculum ) অনুসরণ করবে । অন্যদিকে নিম্ন বুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা সাধারণধর্মী পাঠ্যক্রম ( General curriculum ) বা বৃত্তিমূলক পাঠ্যক্রম ( Vocational curriculum ) অনুসরণ করবে । 

এই পর্যায়ের পাঠ্যক্রমকে তিনি তিনটি মূল শাখায় বিভক্ত করেছেন— ( ১ ) প্রাচীন সাহিত্য ( Classics ) , যার মধ্যে থাকবে ল্যাটিন ও গ্রীক ; ( ২ ) গণিত ( Mathematics ) , যার মধ্যে থাকবে গণিতের বিভিন্ন শাখা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ; এবং ( ৩ ) আধুনিক মানবীয় বিষয় সমূহ , যার মধ্যে থাকবে , আধুনিক ভাষা , ইতিহাস ও সাহিত্য । এছাড়া , রাসেল কয়েকটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়কে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন । এইসব বিষয়গুলি হল— অ্যানাটমি ( Anatomy ) , শরীর বিদ্যা ( Phisiology ) , স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ( Hygiene ) এবং পৌরনীতি । বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন শিক্ষার ( Sex – education ) ব্যবস্থা করার সপক্ষে বার্ট্রান্ড রাসেল অভিমত ব্যক্ত করেছেন । 

উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন — এই স্তরের পাঠ্যক্রমে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং স্বাধীনভাবে গবেষণা ধর্মী কাজে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে হবে । রাসেল তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে শিক্ষার পাঠ্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন । এখানে আমরা তাঁর মূল বক্তব্যটুকু উল্লেখ করলাম মাত্র । 

এই আলোচনা থেকে দেখা যায় , তিনি শিক্ষার পাঠ্যক্রমের মধ্যে গতানুগতিক বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করলেও , সবক্ষেত্রে তিনি শুদ্ধ জ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি । বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবজীবনের প্রয়োজনের কথা স্মরণ রেখে , বিষয়বস্তু উপস্থাপনের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন । তাই তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের পাঠ্যক্রম কেবলমাত্র কতকগুলি তাত্ত্বিক জ্ঞানের সমন্বয় নয় । তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীতে পাঠ্যক্রম হল বিশ্ব প্রকৃতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন মাত্র । 

সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী

ব্রার্ট্রান্ড রাসেল শিশুর প্রকৃত শিক্ষার জন্য কেবলমাত্র গতানুগতিক পাঠ্যবিষয় কেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমের উপর নির্ভর করতে পারেননি । তাই তিনি বিদ্যালয় শিক্ষার সব পর্যায়ে , বিভিন্ন ধরনের সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী ( Co-curricular activities ) পরিচালনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন । তিনি বলেছেন , খেলাধুলা ( Sports ) , কৃষিকাজ ( Agricultural process ) , পশুপালন ( Animal Care ) . উদ্যান রচনা ( Gardening ) , পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ( Observation of nature ) ইত্যাদির মত বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীকক্ষের বহির্ভূত কাজগুলি শিক্ষার্থীদের করার সুযোগ দিতে হবে । প্রত্যেক নাগরিকের জানা উচিত কখন ঋতু পরিবর্তন হয় , কোন ঋতুতে কি ধরনের শস্য উৎপন্ন হয় , কোন পশুর খাদ্য কি , ইত্যাদি । 

রাসেল বলেছেন , এইসব কাজে অংশগ্রহণ করলে শিশুদের সন্তুষ্টি আসে । এইসব সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণের সময় শিক্ষার্থীদের মনে যাতে দুঃসাহসিক অভিযানের প্রবণতা জাগ্রত হয় , সেদিকে শিক্ষককে নজর রাখতে হবে । শিশুরা যাতে এই ধরনের শ্রেণীবহির্ভূত কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় পায় , সে জন্য রাসেল , গতানুগতিক পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তুর পরিমাণ যতটা সম্ভব হ্রাস করার কথা বলেছেন । তাঁর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় , তিনি এই সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।

আরো পড়ুন : বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা দর্শন

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা পদ্ধতি

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

রাসেলের মতে শিক্ষার প্রকৃতি

error: Content is protected !!