শিক্ষা বিজ্ঞান

বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা পদ্ধতি

বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা পদ্ধতি

শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠ্যক্রম সম্পর্কে আলোচনার পর রাসেল শিক্ষণ পদ্ধতি ( Teaching method ) সম্পর্কেও তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন । তিনি নিজস্ব কোন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেননি । কিন্তু প্রত্যেক বিষয় শিক্ষাদানের জন্য তিনি তাঁর নিজস্ব কতকগুলি কৌশল প্রয়োগ করেছেন । বিদ্যালয় শিক্ষার দুটি পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন । তিনি উভয়ক্ষেত্রে আধুনিক মনোবিদ্যা সম্মত শিক্ষাদানের পদ্ধতির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন ।

শিক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক মনোবিদ্যা সম্মত নীতিগুলি গ্রহণ করেছেন । তাঁর গৃহীত এই নীতিগুলি হল— 

( ১ ) শিশুকে কোন কিছু শিখতে বাধ্য করা চলবে না । শিক্ষণ পদ্ধতির প্রথম কথা হবে , এমনভাবে পরিবেশ রচনা করা যাতে শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্রহ সঞ্চারিত হয় । এই আগ্রহ সঞ্চারিত হলে তবেই তার সামনে তথ্য উপস্থাপন করা যেতে পারে । আগ্রহ সৃষ্টি না করে তথ্য পরিবেশন করলে , শিশু মানসিক দিক থেকে তাকে বোঝা মনে করবে এবং বাধা সৃষ্টি করবে ( If , at first , we stimulate the child’s desire to know and then as a favour give him the knowledge he wants , the situation will be entirely different – Russel ) । 

( ২ ) শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে রাসেল বিভিন্ন ক্ষেত্রে মন্তেশ্বরী পদ্ধতি ( Montessori Method ) প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছেন । রাসেল তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলেছেন যে , শৈশবে নামতা ( Multiplication table ) মুখস্থ করতে না পারার জন্য তাঁকে কাঁদতে হত । তিনি দৃঢ়ভাবে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে , মন্তেশ্বরী পদ্ধতিতে পাঠের সুযোগ থাকলে , তাঁকে এরকম অসুবিধায় পড়তে হতো না । 

( ৩ ) যে কোন শিক্ষণ পদ্ধতিতে পাঠ্য বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ ও পুনর্বিন্যাসের সুযোগ থাকা উচিত । অর্থাৎ , বিষয়বস্তুকে প্রত্যেকটি একক ( Unit ) তাদের কাঠিন্যমানের ( Difficulty value ) ক্রমে উপস্থাপন করা একান্তভাবে প্রয়োজন । গণিত , সঙ্গীত , নৃত্য ইত্যাদি বিষয়ে এই নীতি বিশেষভাবে অনুসরণ করা উচিত । 

( ৪ ) শিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার ব্যবস্থা থাকা উচিত । বিশেষভাবে কোন বিষয়বস্তুর কঠিন অংশ শিক্ষার্থীদের আয়ত্ত করতে অনুপ্রাণিত করার জন্য , তিনি প্রশংসা ও তিরস্কারের সুযোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন । তিনি নিজেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে এই নীতি অনুসরণ করেন । 

( ৫ ) রাসেল শিক্ষণ পদ্ধতিকে খেলা ভিত্তিক করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । তিনি বলেছেন , খেলার প্রতি আগ্রহ শিশুদের স্বাভাবিক প্রবণতার অন্তর্গত । সুতরাং , এই স্বাভাবিক প্রণতাকে ব্যবহার করে শিক্ষণ পদ্ধতি রচনা করলে , মনোবিজ্ঞান সম্মত হবে । 

( ৬ ) যে পদ্ধতির মধ্যে শিশুর সৃজন ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ থাকে , তাকেই আদর্শ পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করেছেন । এই সৃজন ক্ষমতা বিকাশের উদ্দেশ্যে তিনি পদ্ধতিকে কর্মভিত্তিক করার সুপারিশ করেছেন । উল্লিখিত সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিক্ষণ পদ্ধতি ছাড়াও , বিশেষ বিশেষ বিষয় শিক্ষণের জন্য রাসেল বিশেষধর্মী কতকগুলি কৌশল প্রয়োগ করার কথা বলেছেন । যেমন— যে সব বিষয় শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে হয় , সেগুলি যান্ত্রিকভাবে অনুশীলন না করে , অভিনয় সহযোগে পুনরাবৃত্তি করার কথা বলা হয়েছে । এই ধরনের অভিজ্ঞতা আনন্দদায়ক হওয়ার দরুন দীর্ঘদিন মনে থাকে । এছাড়া , বিভিন্ন বিষয় ( Subject ) শিক্ষণের জন্য বিশেষ বিশেষ কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ বার্ট্রান্ড রাসেল দিয়েছেন । 

ভাষা শিক্ষণের ব্যাপারে তিনি শিশুদের কম বয়স থেকে বিদেশী ভাষা শিক্ষাদানের কথা বলেছেন । এইক্ষেত্রে তিনি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেছেন । ভূগোল শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে , ছবি , ম্যাপ বর্ণনা ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন । ইতিহাস শিক্ষাদানের সময় , মিউজিয়াম ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । তাছাড়া জীবনী পাঠের মধ্য দিয়ে প্রারম্ভিক স্তরে ইতিহাস শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে সমর্থন করেছেন । তিনি বলেছেন— “ History can profitably be bagun at about five years , with interesting stories of eminent men . ” 

আদর্শ শিক্ষণ পদ্ধতি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন , সেটি হল— শিখন সহায়ক প্রদীপনের ব্যবহারের ( Use of Audio-visual aids ) উপর । বিভিন্ন বিষয় শিক্ষাদানের সময় উপযোগী প্রদীপণ ব্যবহার করলে , শিক্ষার্থীদের সামাজিক সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের প্রচেষ্টা করতে গিয়ে , প্রত্যেক শিক্ষকের এই দিকটির উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত । শিক্ষণপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে রাসেল শিক্ষার্থীর বয়স উপযোগী পদ্ধতি নির্বাচনের উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন । 

তাই শিক্ষার প্রথম পর্যায়ের জন্য তিনি পূর্বোক্ত শিক্ষণ পদ্ধতিগুলির কথা বললে , পরবর্তী উচ্চস্তরের জন্য বিশেষ পদ্ধতির ( Special method ) উল্লেখ করেছেন । এই পর্যায়ের জন্য যে চারটি পদ্ধতির উপর তিনি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন , সেগুলি হল— বক্তৃতা ( Lecture ) , অনুশীলন ( Drill ) , আত্মনিয়ন্ত্রিত পাঠ ( Self – directed study ) এবং বিতর্ক ( Debate ) । বক্তৃতা পদ্ধতি বলতে , তিনি কেবলমাত্র শিক্ষকের বক্তৃতাদানের কাজকে বুঝাননি । তিনি বলেছেন , শিক্ষার্থীরা আদর্শ পাঠ্যপুস্তক পাঠের মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করবে ; কিন্তু এ বিষয়ে তাদের আগ্রহ সঞ্চারের জন্য , শিক্ষক বক্তৃতার আয়োজন করবেন । অর্থাৎ , শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত পাঠের সঙ্গে বক্তৃতার সার্থক সমন্বয় করে পদ্ধতি রচনা করতে হবে । এর ফলে , শিক্ষার্থীদের জানবার আগ্রহ বাড়বে । 

অনুশীলন ( Drill ) পদ্ধতি বলতে তিনি গতানুগতিক অনুশীলনকে বোঝাননি । তাঁর মতে যান্ত্রিক অনুশীলন শিক্ষার প্রতি আগ্রহকে নষ্ট করে । অন্যদিকে অনুশীলন ছাড়াও শিক্ষা সম্ভব নয় । তিনি বলেছেন— ” Pupils must not be encouraged to think that there is short cut to knowledge . ” এই বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য শিক্ষণপদ্ধতিকে এমনভাবে রচনা করতে হবে , যাতে শিক্ষার্থীরা অনুশীলনের সুযোগ পায় , অথচ বিরক্তিবোধ না করে । অর্থাৎ সৃজনাত্মক অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা করা একান্তভাবে প্রয়োজন । 

রাসেল আরো বলেছেন , শিক্ষার উন্নত স্তরে , পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যাতে শিক্ষার্থীরা আত্মগতিতে স্বাধীনভাবে শেখার সুযোগ পায় । সেই কারণে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রিত ( Self directed study ) শিক্ষার কথা বলেছেন । শিক্ষণ পদ্ধতি এমনভাবে রচনা করতে হবে , যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ের বেশীর ভাগ , স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত পাঠ বা পরীক্ষা নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতে পারে । 

সবশেষে , তিনি বিতর্ক সভায় অংশগ্রহণকে শিক্ষণের একটি পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনা করেছেন ( Debates conducted seriously in order to ascertain truth , could be of real value — Russell ) । বিষয়বস্তু উপস্থাপনের জন্য বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে বিতর্ক সভার আয়োজন করা উচিত ।

আরো পড়ুন : বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা দর্শন

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা পদ্ধতি

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

রাসেলের মতে শিক্ষার প্রকৃতি

error: Content is protected !!