রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন
Contents
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন
রবীন্দ্রনাথ মূলতঃ কবি । কিন্তু মানব জীবনের এমন কোন অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র নেই , যেখানে তাঁর চিন্তার ছোঁয়া লাগেনি । মানব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন দিকের উপর তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করে গেছেন । শিক্ষাও তার থেকে বাদ পড়েনি । তাঁর শিক্ষা চিন্তা শুধুমাত্র তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি ; তিনি নিজেই তার প্রয়োগ করে গেছেন । তাই তাঁর শিক্ষাতত্ত্বের মধ্যে কল্পনা বিলাসের বিশেষ কোন স্থান নেই । তিনি শিক্ষাকে “ অশক্তকে শক্তি দেবার উপায় ” হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন । তাই তাঁর শিক্ষা তত্ত্ব বিশেষভাবে বাস্তববাদী ।
ভাববাদ ও প্রয়োগবাদের সমন্বয় :
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন তার জীবন দর্শন দ্বারাই প্রভাবিত । তাঁর এই শিক্ষাদর্শন এক দিকে যেমন ভাববাদী ( Idealist ) চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত , অন্য দিকে প্রয়োগের সময় দেখা যায় , তিনি প্রকৃতিবাদী বা স্বভাববাদী ( Naturalist ) দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছেন । তিনি যেমন বিশ্বমানবাত্মার পরিপ্রেক্ষিতে মানব জীবনের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করেছেন ; শিক্ষার সংজ্ঞাও দিয়েছেন সেই নীতির উপর ভিত্তি করে । তিনি বলেছেন— “ তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা , যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না , যা বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে । ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
তিনি গতানুগতিক শিক্ষাকে বিশেষভাবে সমালোচনা করেছেন । কারণ , তার মধ্যে আমাদের দেশের রীতিনীতি আদর্শ , কোন কিছুকে স্থান দেওয়া হয়নি । ভারতবর্ষ চিরদিনই এইসব নৈতিক গুণগুলির উপর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে ; চিরদিনই সে বিশ্বসত্তার বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে এসেছে ।
তাই তাঁর শিক্ষার লক্ষ্য , তার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতীক হিসাবে যদি দেখা না দেয় , তাহলে তা সমাজের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে না । অতএব যদি আমরা মনে করি , ভারতবর্ষের এই সাধনাতে দীক্ষিত হওয়া ভারতবাসীর শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত , তবে , একথা মনে স্থির রাখতে হবে যে , কেবল ইন্দ্রিয়ের শিক্ষা নয় , কেবল জ্ঞানের শিক্ষা নয় , বোধের শিক্ষাকে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান স্থান দিতে হবে ।
তিনি শিক্ষার লক্ষ্য নির্ণয় করতে গিয়ে ভাববাদী দর্শনের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সংযোগ স্থাপন করেছেন । তিনি ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন । তাছাড়া , পরিপূর্ণ বিকাশের অঙ্গ হিসাবে বিভিন্ন জায়গায় তিনি ব্যক্তিজীবনের যেসব গুণের কথা বলেছেন , তাতে করে বোঝায় তিনি ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন ।
তিনি শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে–
( ১ ) শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশ ,
( ২ ) শিক্ষার্থীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী জাগ্রত করা , যার সাহায্যে শিক্ষার্থী বিশ্বের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করবে ,
( ৩ ) শিক্ষার্থীর মধ্যে ধর্মীয় মনোভাব জাগানো , এবং
( ৪ ) সামাজিক গুণের বিকাশ সাধনকে স্থির করেছেন ।
তাঁর মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে , মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করে গড়ে তোলা ; তার প্রকৃত জীবনাদর্শ গঠনে সাহায্য করা , তার প্রকাশ ভঙ্গীকে ছন্দোময় করে তোলা এবং সবশেষে চরিত্রের বলিষ্ঠতা এনে দেওয়া ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষার পাঠ্যক্রম
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা চিন্তায় পাঠ্যক্রমের ব্যাপক সংজ্ঞাকেই গ্রহণ করেছেন । পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামনে সংস্কৃতির পূর্ণ রূপটি তুলে ধরতে হবে । শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় বিশ্বমানবের সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটানো , তা হলে পাঠ্যক্রম হবে এই সংস্কৃতির বাহক । পাঠ্যপুস্তক সর্ম্পকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “ মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়াছে । ”
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়কে মানব সংস্কৃতির অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করেছেন । আর পাঠ্যক্রম রচনার জন্য সেই সব বিষয়কে গ্রহণ করার কথা বলেছেন , যাদের মধ্য দিয়ে মানব সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করা সম্ভব হবে এবং যার মধ্যে ‘ মনের প্রাণীন ধর্ম বৰ্তমান ‘ ।
এইজন্য তিনি তাঁর পাঠ্যক্রমের ভিতর ভাষা , সাহিত্য , দর্শন , বিজ্ঞান , শিল্পকলা , সঙ্গীত , নৃত্য , পল্লী উন্নয়নমূলক কাজ এবং অন্যান্য সামাজিক কাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন । তিনি ইংরেজী শিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না । তিনি মাতৃভাষার প্রতিই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন । গতানুগতিক শিক্ষা সম্পর্কে দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন— “ ইংরেজী শিখতে গিয়ে না হইল শেখা , না হইল সত্য রাজ্যে প্রবেশ করিবারও অধিকার থাকিল না , সাহিত্যের কল্পনা রাজ্যে প্রবেশ করিবার দ্বার রূদ্ধ রহিল । ”
ভাষা শিক্ষার জন্য এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতির জন্য রবীন্দ্রনাথ রামায়ণ ও মহাভারতকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন । অন্যান্য ভাষা শিক্ষার কথাও তিনি বলেছেন ; বিশেষভাবে সংস্কৃতের কথা । সভ্যতার অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন এবং জীবনের অগ্রগতির জন্য সার্থক জীবনদর্শনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন । তাই বিজ্ঞান ও দর্শনকে তিনি পাঠ্যক্রমের অর্ন্তভুক্তির কথা বলেছেন ।
তাছাড়া , বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্যকে সার্থকভাবে উপলব্ধি করার জন্য শিল্পকলাকে পাঠ্যক্রমের অর্ন্তভুক্ত করার কথা বলেছেন । আবার শিশুকে তার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করবার জন্য সংগীত ও নৃত্যকলাকেও বিদ্যালয়ে চর্চা করতে হবে ।
সব শেষে , সমাজ জীবনের প্রতি সমবেদনামূলক মনোভাব গড়ে তোলার জন্য এবং শিক্ষার্থীর সামাজিক বিকাশে সহায়তা করার জন্য পাঠ্যক্রমের মতে বিভিন্ন ধরনের সমাজ সেবা ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের ব্যবস্থা রাখারও পক্ষপাতী ছিলেন তিনি । সুতরাং দেখা যাচ্ছে , রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠ্যক্রমের ভিতর সম্পূর্ণ মানবের শিক্ষার উপযোগী বিষয় নির্বাচন করেছেন । ফলে তাঁর পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্র বহু বিস্তৃত হয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা পদ্ধতি
রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক শিক্ষণ পদ্ধতিকে সমালোচনা করেছেন ; কিন্তু আধুনিক পরস্পর বিরোধী শিক্ষণ পদ্ধতির কোন একটিকে মেনে নেননি । কারণ , তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের শিক্ষা কৌশল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রকম । তাকে একই নিয়মের বন্ধনে বেঁধে ফেলা যায় না । “ সুখও তাকে শিক্ষা দেয় , দুঃখ তাকে শিক্ষা দেয় ; শাসন নইলেও তাহার চলে না , স্বাধীনতা নইলেও তাহার রক্ষা নাই । ”
শিক্ষণ পদ্ধতির মূল নীতি :
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষণ পদ্ধতি তিনটি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত— ( ১ ) স্বাধীনতা ( Freedom ) ( ২ ) সৃজনশীলতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ( Creative self expression ) এবং ( ৩ ) প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ ( Active communication with nature and man ) ।
স্বাধীনতা বলতে রবীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছাচারের অধিকারকে বোঝাননি । এর অর্থ হল ব্যক্তিত্বের সমস্ত শক্তি উন্মোচন করা এবং বন্ধন মুক্ত এই ব্যক্তিসত্তার সাহায্যে বিশ্বের চিরন্তন শক্তিগুলির সঙ্গে অবাধ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার আয়োজন করা । তাঁর শিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে কাজ করার । তিনি স্বাধীনতাকে আত্মকর্তৃত্বের সমতুল্য হিসেবে বিচার করেছেন । তাই তাঁর বিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রদের যেমন কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের কথা বলেছেন , তেমনি দেহমনের বিকাশের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছেন । তিনি বলেছেন— “ ত্রুটি সংশোধনের দায় নিজে গ্রহণ করার উদ্যম যাদের আছে , খুঁত খুঁত করার কাপুরুষতায় তারা ধিক্কার বোধ করে । ”
এই স্বাধীনতা বা আত্মকর্তৃত্বের প্রধান লক্ষণ হল সৃষ্টি কর্তৃত্ব । স্বাধীন ভাব থেকেই সৃজন প্রতিভার বিকাশ পাবে এবং তার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী নিজেকে বিকশিত করবে । তাই তিনি তাঁর শিক্ষা পদ্ধতিতে গান্ধীজির মত সৃজনাত্মক কাজের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । তিনি বলেছেন— “ শিক্ষা হবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার নিকট অঙ্গ । ‘ আর ‘ আমরা মন খাটাইয়া সজীব ভাবে যে জ্ঞান উপার্জন করি , তাহা আমাদের মনের সঙ্গে মিশিয়া যায় । ‘
তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে শিশুর সক্রিয়তার সুযোগ রেখেছেন । এদিক থেকে তাঁর পদ্ধতির সঙ্গে প্রোজেক্ট পদ্ধতি বা বুনিয়াদী শিক্ষণ পদ্ধতির যথেষ্ট মিল আছে । তিনি বাগান পরিচর্যার কাজ , লাইব্রেরী গোছানোর কাজ , নাটক রচনা , অভিনয় , সংগীত , বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ ইত্যাদির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর পদ্ধতির মধ্যে ।
সবশেষে , তিনি প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে সংযোগ রেখে শিক্ষাদানের কথা বলেছেন । শিশুকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে এবং শিক্ষার মাধ্যমে যাতে সমাজ পরিবেশের সঙ্গে আত্মিক সূত্র স্থাপন হয় , তার ব্যবস্থা করতে বলেছেন । শিক্ষার মাধ্যমে যদি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ না ঘটে , সে শিক্ষার কোন মূল্য নেই । তিনি প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ বলেছেন— ” Children have their active sub – conscious mind which like a tree , has the power to gather its food from the sourrounding atmosphere . For them atmosphere is a great deal more important than rules and methods , buildings , appliances , class – teaching and text books .
মানুষের জন্ম বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবসমাজ এই দু’য়ের মধ্যে । তাই শিক্ষার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ এই দুই উপাদানকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন । তিনি বলেছেন , শিখবার জন্য আলো , বাতাস , গাছপালা , মুক্ত আকাশ — চক , বোর্ড , পুঁথি ইত্যাদির মত আবশ্যকীয় । এই কারণে তিনি আশ্রমিক শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন । তিনি অকপটে তাঁর বিশ্বাসকে ব্যক্ত করেছেন— “ আমার আশা ছিল যে , শান্তিনিকেতনের গাছপালা , পাখিই এদের শিক্ষার ভার নেবে । ”
মন্তব্য
রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেননি । তিনি মনে করতেন , শিক্ষক যদি আদর্শ গুণ সম্পন্ন হন , তাহলে পদ্ধতির নতুনত্বের বিশেষ কোন প্রয়োজন নেই । তিনি বলেছেন— “ মানুষ মানুষের কাছ থেকে শিখতে পারে , যেমন জলের দ্বারা জলাশয় পূর্ণ হয় , শিখার দ্বারা শিখা জ্বলিয়া উঠে , প্রাণের দ্বারা প্রাণ সঞ্চারিত হয় । তাই রবীন্দ্রনাথ সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেননি বা কোন বিশেষ পদ্ধতিকে স্বীকার করেননি । তবে বিভিন্ন জায়গায় , তিনি প্রয়োজনমত পদ্ধতি গ্রহণ করার কথা বলেছেন । তিনি ইন্দ্রিয়ের পরিমার্জনার কথাও বলেছেন ; প্রোজেক্ট পদ্ধতি ও সামগ্রিক পদ্ধতির কথাও বলেছেন ।
আরো পড়ুন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন