বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

বার্ট্রান্ড রাসেল , শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন , তিনি বলেছেন , শিক্ষার দুটি প্রধান লক্ষ্য থাকা উচিত । 

প্রথমত : শিক্ষার লক্ষ্য হবে আদর্শ বা ভাল চরিত্র গঠন করা ( Training of good conduct ) । 

দ্বিতীয়ত : শিক্ষার লক্ষ্য হবে বিশ্ব শান্তি ও আন্তর্জাতিকতাবোধ স্থাপন করা ( Establishing peace and internationalism ) । 

শিক্ষার লক্ষ্য দুটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা প্রসঙ্গে রাসেল বলেছেন , আদর্শ বা ভাল চরিত্রের ( Good conduct ) ধারণার মধ্যে কোন সমতা নেই । তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন , সব ব্যক্তির মধ্যে সব রকম আদর্শের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমানভাবে থাকে না । সুতরাং , শিক্ষার মাধ্যমে কোন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ করা হবে , তা পূর্বে চিহ্নিত করার প্রয়োজন । 

তাঁর মতে , এমন কতকগুলি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে , যেগুলি সার্বজনীন । এই সার্বজনীন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে শিক্ষার মাধ্যমে , প্রশিক্ষিত করে তোলার দরকার । তিনি বলেছেন— “ We must first make a distinction between the qualities which are desirable , in a certain proportion of mankind and others which are desirable universally . ” । তিনি যুক্তির দ্বারা এরকম মূল চারটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচন করেছেন । এইগুলি হল — জীবনীশক্তি ( Vitality ) , সাহস ( Courage ) , সংবেদনশীলতা ( Sensitiveness ) এবং বুদ্ধি ( Intelligence ) । 

প্রথমত : জীবনীশক্তি মূলতঃ দৈহিক স্বাস্থ্য নির্ভর । সুতরাং , শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা করে , তার জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করা যায় । আর এই জীবনীশক্তি মানুষকে আনন্দ দান করে , জীবনের বেদনা দূর করে । রাসেল বলেছেন— “ It makes one’s own existence pleasant . ” সুতরাং শিক্ষার একটি প্রধান লক্ষ্য হল — শিক্ষার্থীকে দৈহিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা । 

দ্বিতীয়ত : রাসেল সাহসিকতাকে ( Courage ) আদর্শ চরিত্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করেছেন । সাধারণ অর্থে সাহসিকতা বলতে আমরা ভয়হীনতাকে বুঝি । কিন্তু রাসেল , সাহসিকতা বলতে অন্য ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বুঝিয়েছেন । তাঁর মতে মানুষ যখন তার নিজের আন্তরিক বিচার বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আচরণ সম্পাদন করে , তখনই সাহসিকতার প্রকাশ হয় । তবে আত্মকেন্দ্রিকতা সাহসিকতার লক্ষণ নয় । আত্মবুদ্ধিতে যে ব্যক্তি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে পারে , সেই প্রকৃত সাহসী । তিনি বলেছেন— “ The perfection of courage is found in the man of many interests , who feels his ego to be but a small part of the world , not though despising himself , but through valuing much that is not himself . ” অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চারিত্রিক গুণাবলী , যেগুলির অভাব ব্যক্তির মধ্যে আছে , সেগুলির প্রতি শ্রদ্ধাবোধও সাহসিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য । শিক্ষার লক্ষ্য হবে , এই ধরনের শ্রদ্ধা যুক্ত সাহসিকতার বিকাশ সাধন করা । 

তৃতীয়ত : চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে রাসেল বলেছেন সংবেদনশীলতা ( Sensitiveness ) । সংবেদনশীলতা , তাঁর মতে হল — প্রক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া সম্পাদনের ক্ষমতা । তিনি এখানে ব্যক্তির তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন । সংবেদনশীল ব্যক্তির অনেক বেশী সংখ্যক উদ্দীপক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে । সংবেদনশীল ব্যক্তির প্রক্ষোভিক প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে যথার্থতা বজায় থাকে । সবশেষে , সংবেদনশীলতার চরম পর্যায়ে ব্যক্তির প্রক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া বিমূর্ত উদ্দীপক পরিস্থিতির ( Abstract stimulus ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । রাসেল এই তৃতীয় বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত করতে শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছেন । তিনি বলেছেন— “ An education producting sensitiveness to abstract stimuli would wipe out a large proportion of the evils that exist in the modern world to – day . ” অর্থাৎ , শিক্ষার্থীকে জীবনাদর্শের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা হবে শিক্ষার লক্ষ্য । 

চতুর্থত : আদর্শ চরিত্রের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হিসাবে রাসেল বুদ্ধির ( Intelligence ) কথা উল্লেখ করেছেন । বুদ্ধি বলতে তিনি জ্ঞান ( knowledge ) এবং জ্ঞান আহরণের আগ্রহ ( Receptivity to knowledge ) উভয়কে বুঝিয়েছেন । তিনি বলেছেন , জ্ঞান ছাড়া বৌদ্ধিক বিকাশ সম্ভব নয় । জ্ঞান আহরণের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গী ব্যক্তির বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করে । তাই শিক্ষার একটি প্রধান লক্ষ্য হবে , শিক্ষার্থীর চিন্তার ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গী জাগ্রত করা । তিনি বলেছেন- ” Open mindedness should be one of the qualities that education should aim at and develop it in children . ” 

জীবনীশক্তি ( Vitality ) , সাহস ( Courage ) , সংবেদনশীলতা ( Sensitiveness ) ও বুদ্ধি ( Intelligence ) ইত্যাদি চারটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিকাশের উপর রাসেল গুরুত্ব দিলেও , তিনি আরো কতকগুলি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , শিক্ষার দ্বারা বিকাশের কথা বলেছেন । এইসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল — সহযোগিতা ( Co-operation ) ও সত্যনিষ্ঠা ( love for truth ) । 

সুতরাং আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে , রাসেল শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে শিক্ষার্থীর দৈহিক , প্রক্ষোভিক , মানসিক , বৌদ্ধিক ও সামাজিক বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন । তবে , ব্যক্তি জীবনের এই সকল দিকের বিকাশ যাতে বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হয় , সে দিকে শিক্ষাকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে । 

রাসেলের ধারণা ছিল গতানুগতিক শিক্ষার মধ্য দিয়েও ব্যক্তির চরিত্রের বিভিন্ন দিকের বিকাশ করা যায় । তবে , সেই বিকাশ সব সময় পরিপূর্ণ হয় না । কারণ , ব্যক্তিসত্তা বিকাশের বিভিন্ন দিকগুলির মধ্যে অনেক সময় পরস্পর বিরোধিতা থেকে যায় । তাই এই সমস্ত দিকের সমন্বয়ের জন্য তিনি সব সময় শান্তি ও আন্তর্জাতিকতা বোধের আদর্শকে সামনে রাখার কথা বলেছেন । অর্থাৎ , তাঁর মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে – বিশ্ব শান্তি বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা । আর সেই উদ্দেশ্যে ব্যক্তির চরিত্রের যে ধরনের পরিবর্তন দরকার , শিক্ষার মাধ্যমে তা আনতে হবে । তিনি বলেছেন— “ For establishment of permanent peace , besides some economic and political conditions , there are some psychological conditions which should be fulfilled . This should be the aim of physical , moral as well as intellectual education , that it should discourage such type of character building which encourages people to draw pleasure from violence and war . ” ।

আরো পড়ুন : বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা দর্শন

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার পাঠ্যক্রম

বার্ট্রান্ড রাসেলের শিক্ষা পদ্ধতি

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

রাসেলের মতে শিক্ষার প্রকৃতি

error: Content is protected !!