কার্ল মার্কসের সমাজ দর্শন

কার্ল মার্কসের সমাজ দর্শন

মার্কসীয় দর্শনের ( Marxist philosophy ) উদ্ভব হয়েছে বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক হেগেল এর ( Hegel ) দর্শন থেকে । হেগেল বলেছিলেন ” ব্যক্তি ( Individual ) সমাজের ( Society ) জন্য এবং সমাজই মুখ্য সত্তা বা ব্যক্তিকে অস্তিত্ব দান করেছে ।” মার্কস ( Karl Marx ) তাঁর সমাজদর্শনে , তাঁর এই পূর্বসুরীকে অনুসরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে যে মতবাদ গড়ে তুললেন তাই আজ মার্কসীয় দর্শন নামে পরিচিত । এই মার্কসীয় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বর্তমানে আরো একজন জার্মান চিন্তাবিদের নাম করা হয় । তিনি হলেন ফ্রেডরিখ এঞ্জেলস ( Fredrich Engels ) । 

মার্কসীয় মতবাদের উৎস হেগেলীয় দর্শন হলেও তা সম্পূর্ণভাবে বিপরীত রূপ ধারণ করেছে । কারণ , মার্কস প্রথমেই গতানুগতিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করে বলেছেন— “ The philosophers have only interpreted the world in various ways , the point , however , is to change it . ” অর্থাৎ , মার্কস প্রথম থেকেই বাস্তবদৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চিন্তা করেছেন । হেগেল ( Hegel ) যেখানে চরম মনকে ( Absolute mind ) প্রকৃত সত্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় মননকে চরম বাস্তব হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন , সেখানে মার্কস্ বস্তু জগৎকেই চরম বাস্তব হিসাবে গ্রহণ করেছেন । তাই মার্কসীয় দর্শনকে বস্তুবাদী দর্শন ( Materialism ) বলা হয় । 

মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ( Dialectic Materialism ) তত্ত্বে বলেছেন বস্তু জগৎ পরিবর্তনশীল । এই পরিবর্তন সংঘটিত হয় স্বাভাবিক নিয়মে বা প্রাকৃতিক নিয়মে । মানুষের সঙ্গে বস্তু জগতের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় , তাকে মানুষের মনঃপ্রকৃতির দ্বারা বা বস্তুজগতের প্রকৃতির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না । তার মূল উৎস হল মানুষের জীবন পরিবেশ বা আরো সীমিত অর্থে তার অর্থনৈতিক পরিবেশ । মার্কস এর মতে , সমাজে প্রচলিত আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মার্কস তাঁর সামাজিক তত্ত্বের বিস্তার করেছেন ।

তিনি বলেছেন , সমাজের অন্তর্গত সদস্যদের শ্রেণীবিন্যাস , আর্থিক অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হয় । ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিচার করলে দেখা যায় , বিভিন্ন সময়ে সমাজের আর্থিক বণ্টনের প্রকৃতি সামাজিক বিন্যাসে ( Social organisation ) সহায়তা করেছে । মার্কস বলেছেন — সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির দুটি প্রধান উপাদান – একটি হল উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক ( Relations of production ) এবং অপরটি হল — উৎপাদনের শক্তি সমূহ ( Forces of production ) । অর্থাৎ , অর্থনৈতিক উৎপাদনে , মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে । মার্কস  এর মতে , এই পারস্পরিক সম্পর্ক মূলতঃ মালিক ( Owner ) এবং শ্রমিকের ( Labourer ) মধ্যে স্থাপিত হয় । 

অন্যদিকে , উৎপাদনের শক্তি বলতে তিনি উৎপাদনে ব্যবহৃত হাতিয়ার , কাঁচামাল ( Raw material ) , দক্ষতা ( Skill ) ইত্যাদিকে বুঝিয়েছেন । এইসব উৎপাদনের শক্তিগুলি সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশে সহায়তা করে । মার্কস বলেছেন , সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ( Economic base ) তার পরিপূর্ণ কাঠামোটি নির্ধারণ করে এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস ঘটায় এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করে । 

সামাজের এই অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে মার্কস সামাজিক বিবর্তনের ধারাটিকেও অনুশীলন করেছেন , ঐতিহাসিক পটভূমিতে । তিনি বলেছেন , মনুষ্য সমাজ চারটি স্তরের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে । এই চারটি স্তর হল — আদিম কমিউনিজম বা সাম্যাবস্থা ( Primitive Communism ) , দাসত্ব ( slavery ) , সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ( Feudalism ) এবং ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ( Capitalism ) । তাঁর মতে আদিম মনুষ্য সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । কারণ তখন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না । সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সবকিছুই উপর সমান অধিকার ছিল । 

কিন্তু ধীরে ধীরে উৎপাদনের শক্তির ( Forces of Production ) পরিবর্তন হতে লাগলো নতুন নতুন হাতিয়ার ( Tools ) উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে । তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদনের সম্পর্ক ( Relations of production ) এর পরিবর্তন ঘটলো । সমাজের মধ্যে দুই শ্রেণীর মানুষের সৃষ্টি হল । এক শ্রেণী হল মালিক বা শোষক শ্রেণী ( Owner of Exploiter ) । উন্নত উৎপাদন শক্তিগুলি , এদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল । ফলে , সমাজের মধ্যে অপর যে শ্রেণীর মানুষ সৃষ্টি হল তাদের বলা যেতে পারে দাস বা শোষিত শ্রেণী ( Slave or Exploited ) । প্রথমোক্ত শ্রেণীর মানুষ , এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষকে ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করার ক্ষমতা অর্জন করল । এমনিভাবে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন হল । 

সামগ্রিকভাবে আদিম সাম্যাবস্থার সমাজ বিবর্তিত হয়ে দাস প্রথায় রূপান্তরিত হল । সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন হল । পরবর্তী পর্যায়ে দাস প্রথা রূপান্তরিত হয়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ( Feudalism ) জন্ম দিল । মালিক শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা রূপান্তরিত হল এক একজন সামন্তরাজ ( Feudal lord ) হিসাবে । এরাই উৎপাদনের বেশীরভাগ অংশগ্রহণের অধিকারী হল । অন্যদিকে অধঃস্তন শ্রেণীর মানুষেরা উৎপাদনের খুব সামান্য অংশই পেল । এমনিভাবে উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের ফলে মনুষ্য সমাজ আজ তৃতীয় স্তরে উন্নীত হল । 

মার্কস শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপীয় সমাজকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন । শিল্প বিপ্লবের ফলে , উৎপাদন শক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল । আর তার প্রভাবে , সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসেরও পরিবর্তন হয়েছিল । সমাজ বিবর্তনের এই পর্যায়কে মার্কস বলেছেন ধনতান্ত্রিক অবস্থা ( Capitalism ) । এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় , উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মালিক শ্রেণী , কর্মচারীকে স্বল্প মজুরীতে বেশী পরিশ্রম করতে বাধ্য করছে । তিনি একে সমাজ ব্যবস্থায় চরম শোষণের পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেছেন । মার্কস বলেছেন , এই ধরনের সামাজিক অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না । স্বাভাবিক নিয়মে , এই অবস্থার অবসানে সাম্যবাদ আসতে বাধ্য । এই অবস্থার পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে । 

এর মধ্যে প্রথম ব্যবস্থা হল —ব্যক্তিগত মালিকানা রোধ করা বা মালিকানাকে রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করা । মার্কস বলেছেন , শ্রেণী সংগ্রামের ( class struggle ) প্রধান কারণ হল ব্যক্তিগত মালিকানা । সুতরাং , ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটলে , সামাজিক দ্বন্দ্বের অবসান হবে । আর তার ফল হিসাবে সমাজেও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে । অপরদিকে মার্কস বলেছেন , ধনতান্ত্রিক অবস্থা থেকে সমাজের সাম্যাবস্থায় বিবর্তন ঘটে বিপ্লবের ( Revolution ) মাধ্যমে । মার্কস এবং এঞ্জেলস বলেছেন — বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ শ্রমজীবী মানুষের হাতে আসবে এবং সমাজ ব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তার অনুপ্রেরণাও তারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পাবে । 

সুতরাং , মার্কসের সমাজ দর্শনের চরম লক্ষ্য হল — বৈপ্লবিক পথে শ্রমজীবী মানুষের এমন এক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন , যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না , শোষণ থাকবে না , এবং সামাজিক উৎপাদনের উপর সকলের সমান অধিকার থাকবে । এই পথেই শ্রেণী সংগ্রামের অবসান হবে , মার্কস তাই বিশ্বাস করতেন । 

মার্কস এর সমাজ দর্শনের তাৎপর্য

মার্কস এর এই সমাজ দর্শনের তাৎপর্য বিচার করতে গেলে , ব্যক্তি ( Individual ) বা মানুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন । আর এই ব্যক্তি সংক্রান্ত ধারণা তাঁর শিক্ষানীতিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলবে । 

তিনি মানুষকে একশ্রেণীর উৎপাদনশীল জীব হিসাবে বিবেচনা করেছেন । তিনি মানুষের  মন ( Mind ) বা , চেতনাকে ( Consciousness ) বস্তুগত দিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন । তার মন বস্তুজগতের প্রতিফলন ( Reflection ) মাত্র । মার্কস এর পূর্বে অন্যান্য প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা বলেছিলেন— “ মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে বজায় রাখে ” ( Consciousness of man determines his existence ) । কিন্তু মার্কস মানুষের প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে এর ঠিক বিপরীত কথা বললেন— “ Men’s social existence determines their consiousness . ” অর্থাৎ , মার্কস এর মতে , মানুষের চিন্তাধারা , বিশেষ বিশেষ ধারণা এবং আদর্শগুলি আকস্মিক ভাবে গড়ে উঠেনি । সামাজিক ও প্রাকৃতিক জীবন পরিবেশই সেগুলিকে নির্ধারণ করে দিয়েছে । ফলে , মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি কতকগুলি সিদ্ধান্ত করেছেন । তাঁর এই সিদ্ধান্তগুলি হল— 

( ১ ) মানুষ সম্পূর্ণভাবে বস্তুধর্মী ( Man is a purely material being ) । তার সৃষ্টি ও বিকাশের উৎস হল তার প্রাকৃতিক পরিবেশ ( Nature ) । 

( ২ ) মানুষের মন বা আত্মা বলে কোন পৃথক সত্তা নেই ( There is no seperate entity like mind of soul ) । তার জড় দেহের জটিল বহিঃপ্রকাশই হল তার মন । 

( ৩ ) মানুষের ব্যক্তিগত কোন স্বাধীনতা থাকা উচিত নয় ; তবে দলগত ইচ্ছা অনুসরণ করার তার স্বাধীনতা আছে । 

( ৪ ) মানুষকে জানতে হলে , তাকে বুঝতে হলে , বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অনুশীলন করতে হবে । কোন তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক ধারণা মানুষকে জানতে সহায়তা করে না । 

( ৫ ) মানুষের ধর্মীয় চেতনা বা আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব , হীনমন্যতাবোধ থেকে সৃষ্টি হয় । মানুষ যখন তার অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে , তখন তার এই হীনমন্যতা বোধের অবসান হবে । 

মার্কস মানুষ সম্পর্কে সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তাহল এই যে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের শ্রমের উপজাত ফল ( Man is the product of his own labour ) । তার চেতনা হল— শ্রেণী চেতনা ( His only Consciousness is class-consciousness ) এবং তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল— শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টি করা বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা ( His only goal is to create a class-less society ) ।

আরো পড়ুন : কার্ল মার্কসের মতে শিক্ষার লক্ষ্য পাঠ্যক্রম ও শিক্ষালয়

মার্কসীয় শিক্ষা তত্ত্ব

কার্ল মার্কসের সমাজ দর্শন

মার্কসবাদের উৎস

মার্কসবাদ কি

error: Content is protected !!