রাষ্ট্র বিজ্ঞান

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সম্পর্ক

মানুষ অত্যন্ত ভাবপ্রবণ । ভাবের আবেগে উচ্ছসিত হয়ে সে অনেক কাজ করে । মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে মানুষের সেই সকল কার্যাবলীর , যা মানুষ ভাবের আবেগে উচ্ছসিত হয়ে করে থাকে । আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচিত হয় মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক কার্যাবলী । এই রাষ্ট্রনৈতিক কার্যাবলীর মধ্যে কতকগুলি আবার মানুষ ভাবের আবেগে করে থাকে । এই ভাব-ভিত্তিক ও উত্তেজনা-প্রসূত কার্যাবলীও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচিত হয় । 

বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোগুলি সাধারণত গণতান্ত্রিক । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । এক কথায় বলা যায় , বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জনমতের উপর নির্ভরশীল । এইজন্য জনমতকে ব্যক্ত করিবার জন্য নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে । জনমত আবার মানুষের মানসিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল । এই কারণে , ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মনস্তত্বের অনুধাবন প্রয়োজন । সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ।

রাষ্ট্রের প্রতিভূ হল সরকার । গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে জনসাধারণের মানসিক ধারণা ও নৈতিক বিশ্বাসের উপর । মনোবিজ্ঞান পাঠ করে মানুষের মানসিক ধারণা সম্বন্ধে জানতে পারা যায় । এইজন্য , প্রত্যেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে মানুষের মানসিক ধারণা , মনোবৃত্তি ও ভাবপ্রবণতা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানলাভ করতে হয় । অন্যথায় , তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র নির্ধারণ করতে সমর্থ হয় না । এই কারণেই লর্ড ব্রাইস  বলেছেন , “ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিকড় আছে মনোবিজ্ঞানের মধ্যে ” ।

বর্তমানে জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য আলোচ্য বিষয়বস্তু । এই জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত সমস্যা সমূহের সমাধানের সূত্রগুলি মনোবিজ্ঞানে আলোচিত হয় । মানুষের ভাবপ্রবণতা , মনোবৃত্তি , ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের গৌরব যা মনোবিজ্ঞানে আলোচিত হয় , তাই হলো জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা । অতএব দেখা যায় , রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু ও মনোবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বস্তুর মধ্যে নিকট সম্পর্ক আছে ।

আবার দল ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয় না । এই দলগঠনের পিছনে মানুষের মনের ভাব ও সহজাত প্রবৃত্তি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে । সুতরাং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু মনস্তত্ত্বের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয় ।

আধুনিক যুগে দল গঠনে , সেনাবাহিনী গঠনে , বিচারালয়ে বহু মনস্তাত্বিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় । এই প্রসঙ্গে বার্কারের  মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে । তিনি বলেন : “ রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যাবলীর ব্যাখ্যায় মনোবিজ্ঞানের সমাধান সমূহের ব্যবহার যেন বর্তমান দিনের রীতি হয়ে দাড়িয়েছে । ” বেজহট ( Bagehot ) , ম্যাকডুগাল ( McDougall ) , লেবন ( Le Bon ) , গ্রাহাম ওয়ালাস ( Graham Wallas ) , স্পেনসার প্রভৃতি আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদ , পণ্ডিতগণ দেশের শাসন ব্যবস্থার উপর মনস্তত্ত্বের প্রভাব ও গুরুত্বের উল্লেখ করেছেন । রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন সংস্কারের দাবিতে যে গণআন্দোলন শুরু হয় , তা কি ভাবাবেগ প্রসূত , না সত্যই কোন প্রকৃত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে । এই বিশ্লেষণ কার্যে মনস্তত্ত্বের জ্ঞান বিশেষভাবে সহায়তা করে । 

আবার বিভিন্ন দেশের শাসন ব্যবস্থার পার্থক্যের পিছনে আছে সংশ্লিষ্ট দেশের গঠন , প্রকৃতি ও মনোভাবের পার্থক্য । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , সুইজারল্যান্ড বা ইংল্যান্ডে যে শাসন ব্যবস্থা সাফল্য মণ্ডিত হয়েছে , তা অন্য দেশে সাফল্য লাভ করতে পারে নি । কারণ অন্য দেশের জনসাধারণের গঠন , প্রকৃতি ও মনোভাবের সঙ্গে এই দুই দেশের জনসাধারণের গঠন , প্রকৃতি ও মনোভাবের পার্থক্য আছে । সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা কালে মনস্তত্বের সাহায্য গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় ।

উপসংহারে বলা যায় , মনোবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বটে , কিন্তু মনোবিজ্ঞানের পদ্ধতি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সর্বত্র প্রযোজ্য নয় । মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে অবস্থার আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে আদর্শের । মনোবিজ্ঞান রাষ্ট্রের কার্যাবলীর ঔচিত্য বা অনৌচিত্য নিয়ে আলোচনা করে না । রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে অবস্থা ও আদর্শের এবং নির্দেশ দেয় কি হওয়া উচিত বা কি হওয়া উচিত নয় । অতএব রাষ্ট্রবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে প্রয়োজন অনুসারে তার ব্যবহার করে কিন্তু অন্ধভাবে তা অনুসরণ করে না ।

error: Content is protected !!