রাষ্ট্র বিজ্ঞান

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতি শাস্ত্রের সম্পর্ক

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতি শাস্ত্রের সম্পর্ক

প্রাচীন দার্শনিকগণ নীতিশাস্ত্রকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিলেন । তাদের মতে নীতিশাস্ত্রই মূল শাস্ত্র । আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে তারা শাখা রূপে কল্পনা করেছেন । প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে যে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার কল্পনা করেছেন তা নৈতিক আদর্শ ভিত্তিক । অ্যারিস্টটল তাঁর রাষ্ট্রনীতি গ্রন্থে লিখেছেন যে ,  মঙ্গলময় সুন্দর জীবন সম্ভব করার জন্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মানুষের এই সুন্দর জীবনের মধ্য দিয়েই মূর্ত হয়ে ওঠে । রাষ্ট্রই নাগরিকের চরিত্র নির্ণয় করে । সুরাষ্ট্রের মধ্যে সুনাগরিকের সন্ধান পাওয়া যায় । পূর্বে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল সূত্র গুলি নীতিশাস্ত্রের ভিত্তিতে নির্ধারিত হত ।

শুধু প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্র এর আদর্শ নৈতিক আদর্শ ভিত্তিক ছিল না । প্রাচীন ভারতের গ্রন্থসমূহেও দেখা যায় প্রাচীন ভারতে রাজা ও প্রজার দায়িত্ব ও কর্তব্য নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হত । রাষ্ট্রের এই নৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন ঘটে ষোড়শ শতাব্দীতে । এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি ( Machia velli ) সর্বপ্রথম রাষ্ট্রনীতিকে নীতিশাস্ত্র থেকে পৃথক করে সুবিধাবাদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন । 

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতি শাস্ত্রের পার্থক্য

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে বল প্রয়োগের মতবাদ , সামাজিক চুক্তির মতবাদ প্রভৃতি প্রচারের ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিশাস্ত্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে পড়েছে । ম্যাকিয়াভেলির পরবর্তীকালে হবস , লক , রুশো প্রমুখ দার্শনিক তাদের সামাজিক চুক্তির মতবাদ প্রভৃতি প্রচার করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে রূপদান করেন । কিন্তু এটা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্র হিসাবে পরিগণিত হলেও এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় আছে । রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য গুলি নিম্নে আলোচনা করা হইল : 

( ১ ) নীতিশাস্ত্র আলোচনা করে মানুষের মনের চিন্তা ও তার বাহ্যিক আচরণের । রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে শুধু বাহ্যিক আচরণের । মনের চিন্তা নিয়ে তার কারবার নয় । আবার মানুষের সকল প্রকার বাহ্যিক আচরণই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয় না । রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক আচরণের । 

( ২ ) নীতিশাস্ত্রের নীতি ন্যায় ভিত্তিক — রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীতি ন্যায় অন্যায়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না । এটি রাষ্ট্রের সুবিধা ( expediency ) দ্বারাই নির্ধারিত ।

( ৩ ) নীতিশাস্ত্রের বিষয়বস্তু ব্যাপক , কারণ এটি মানুষের সমগ্র জীবনের আলোচনা করে । আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে শুধু মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবন , রাষ্ট্রের কার্যাবলী প্রভৃতি ৷ অতএব দেখা যায় , নীতিশাস্ত্রের তুলনায় রাষ্ট্র বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু সংকীর্ণ । 

( 8 ) নীতিশাস্ত্রের নীতি পালন বাধ্যতামূলক নয় ; কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আইন বাধ্যতামূলক । পিতা মাতাকে ভক্তি না করলে দৈহিক শাস্তি পেতে হয় না , কিন্তু রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘনকারীকে দৈহিক শাস্তি পেতে হয় । 

 রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতি শাস্ত্রের সাদৃশ্য

উপরি উক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে নীতিশাস্ত্র থেকে সম্পূর্ণ ভাবে পৃথক করা যায় না । রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের উদ্দেশ্য একই হওয়ায় উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । উভয় শাস্ত্রই মানুষকে সুন্দর করে গড়তে চাই এবং মানুষকে ন্যায় অন্যায় সম্বন্ধে অবহিত করে । 

রাষ্ট্র যে সকল আইন প্রণয়ন করে , তার বৈধতা নীতিশাস্ত্রের মানদণ্ডে স্থির করা হয় । রাষ্ট্র প্রণীত আইন যদি নীতি বিরুদ্ধ হয় , তাহলে জনগণ তা মানতে চায় না । রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হল সুনাগরিক সৃষ্টি করা । এই ভাবে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে জনমতের পরিবর্তন সাধন করে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , পূর্বে ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা চালু ছিল এবং এটি নৈতিক বলেও বিবেচিত হত । কিন্তু পরে যখন রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এই প্রথা রদ করে , তারপর ধীরে ধীরে জনগণের নৈতিক জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটে । বর্তমানে সতীদাহ প্রথাটি অনৈতিক বলে মনে করা হয় । 

ব্যক্তি ও সমষ্টির কল্যাণ সাধনকারী , সমাজ কল্যাণকর রাষ্ট্র মাত্রই নৈতিক আদর্শ ভিত্তিক । এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আইভর ব্রাউন  বলেছিলেন যে ,” নীতিশাস্ত্রের ধারণা সকল প্রতিফলিত না হলে রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ অর্থহীন , আবার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ বর্জিত নৈতিক মতবাদ অসম্পূর্ণ ।” 

রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হইল এমন এক সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি করা যেখানে মানুষ তার সত্ত্বাকে পূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে । এই আদর্শকে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্র যে সকল কার্য করে তার অধিকাংশই নীতিশাস্ত্রের নির্দেশে সম্পাদিত হয় । অতএব , এটা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র পরস্পরের পরিপূরক । রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতি শাস্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না । 

নীতিশাস্ত্রের নৈতিক আদর্শ যখন মানুষের আচার ও ব্যবহারের মধ্যে প্রকাশ পায় এবং এটি সমাজবদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রীতি নীতি হয়ে দাঁড়ায় , তখন তা মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে । নীতিশাস্ত্রের সূত্রগুলি যখন বদ্ধমূল হয়ে যায় , তখন আবার এইগুলি আইনরূপেও প্রণীত হয় । রাষ্ট্র প্রণীত আইন যদি নৈতিক আদর্শ বর্জিত হয় , তবে তা বেশী দিন স্থায়ী হয় না । অধ্যাপক গেটেলের ভাষায় বলা যায় , রাষ্ট্রের কার্যাবলী নির্ধারিত হয় ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত মঙ্গল সাধনের জন্য নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে । 

সুতরাং দেখা যায় , রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত । এবং এটা আশা করা যায় , এই সম্পর্ক চিরকাল থাকবে । কারণ অন্যথায় নৈতিক আদর্শ বর্জিত সমাজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ।

error: Content is protected !!