রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রদর্শন
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রদর্শন
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অনেকে ‘ রাষ্ট্রদর্শন ’ ( Political Philosophy ) নামে অভিহিত করে থাকেন । তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রের দার্শনিক তাৎপর্য বিশ্লেষণই হল রাষ্ট্রদর্শনের উদ্দেশ্য । রাজনৈতিক জীবনের ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে কোন আলোচনা এই শাস্ত্রে থাকে না । রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদর্শন উদ্ভব , বিবর্তন , প্রকৃতি , কার্যাবলী , সংগঠন , রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক , নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যেই রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনা সীমাবদ্ধ । রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠন , তাদের কার্যাবলী , কার্যপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় এর এক্তিয়ারের বাইরে ।
বস্তুত রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনা ভাবভিত্তিক । রাষ্ট্রের ব্যবহারিক আলোচনা রাষ্ট্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত হয় না । রাষ্ট্রদর্শনের আলোচনায় ঔচিত্য-অনৌচিত্যের নীতিমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয় । রাষ্ট্রের প্রকৃতির ভালমন্দের দিক , রাষ্ট্রের কি করা উচিত , কি করা উচিত নয় , নীতিশাস্ত্রের মত এরকম নির্দেশমূলক বিষয়ও রাষ্ট্রদর্শনে বর্তমান থাকে ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে যাঁরা রাষ্ট্রদর্শন বলতে চান না , তাদের মতানুসারে রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই অন্তর্ভুক্ত বিষয়মাত্র । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র অনেক বেশী ব্যাপক । রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রকৃতি , আদর্শ , লক্ষ্য , বিবর্তন প্রভৃতি দার্শনিক বিষয়ের সঙ্গে সরকারের গঠন , কার্যাবলী , পরিচালনা , নানারকম প্রশাসনিক বিষয়ের সমস্যা প্রভৃতি ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতির বিষয়ও থাকে । রাষ্ট্রের দার্শনিক আলোচনার সঙ্গে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতিকে সংযুক্ত করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করে । অর্থাৎ দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা ব্যবহারিক বর্ণনামূলক দিকও আছে ।
তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়কে দু-ভাগে বিভক্ত করে থাকেন । এই দুটি ভাগ হল – দার্শনিক বা উদ্দেশ্যমূলক ( Prescriptive ) এবং বর্ণনামূলক ( Descriptive ) । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্ণনামূলক আলোচনা বস্তুগত , নৈর্ব্যক্তিক ও বৈজ্ঞানিক । অপরদিকে উদ্দেশ্যমূলক বা নির্দেশমূলক আলোচনায় নৈতিক বা ঔচিত্য-অনৌচিত্যের আধিক্য দেখা যায় । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় উভয় ধরনের বিষয়বস্তু আছে ।
রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বর্ণনামূলক বিষয়গুলি রাষ্ট্রদর্শনের এক্তিয়ারের বাইরে থাকে । অর্থাৎ রাষ্ট্রদর্শনের আলোচ্য বিষয়ের সবকিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বর্তমান ; কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সব কিছু রাষ্ট্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয় । সুতরাং রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ মাত্র ।
প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রনীতি উভয়বিধ আলোচনাই থাকে । তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অংশের আলোচনা তত্ত্বগত ( Ideas ) এবং অপর অংশের আলোচনা প্রতিষ্ঠানগত ( Institutions ) । রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান । তাই আলোচ্য শাস্ত্রটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামকরণই হল সঙ্গত এবং সর্বজনগ্রাহ্য ।