রাষ্ট্র বিজ্ঞান

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতি

অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে রাষ্ট্রনীতি বলেন । গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল ( Aristotle ) এর রাষ্ট্র সম্পর্কিত কালজয়ী গ্রন্থটির নাম হল ‘ রাষ্ট্রনীতি ‘( Politics ) । সিজউইক ( Sidgwick ) , লর্ড অ্যাকটন ( Acton ) , জেলিনেক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও ‘ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ’ পরিবর্তে ‘ রাষ্ট্রনীতি ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন । গ্রীক শব্দ ‘ পলিস ’ ( Polis ) থেকেই ইংরাজী ‘ পলিটিক্স ‘ ( Politics ) শব্দটির উৎপত্তি । ‘ পলিস’এই গ্রীক শব্দটির দ্বারা নগরকে বোঝান হত । প্রাচীনকালে গ্রীকদের কাছে নগরই ছিল রাষ্ট্র । তাকে নগর রাষ্ট্র ( City State ) বলা হত । সুতরাং এদিক থেকে ‘ নগর রাষ্ট্র ’ ও তার সমস্যাদি সম্পর্কিত আলোচনাই হল ‘ রাষ্ট্রনীতি ‘ ( Politics ) ।

এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ‘ রাষ্ট্রনীতি ’ শব্দটি ব্যবহার করার বিরুদ্ধে । অ্যারিস্টটল এর আমলে গ্রীস দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল নগর রাষ্ট্র ভিত্তিক । এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার পরিধি নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ সীমাকে অতিক্রম করেছে এবং বহুদূর প্রসারিত হয়েছে । বর্তমানে এক একটি রাষ্ট্র বিস্তৃত ভৌগোলিক পরিধির উপর কোটি কোটি অধিবাসীকে নিয়ে গঠিত । শুধু  আয়তন ও জনসংখ্যাই যে বেড়েছে তা নয় , রাষ্ট্রীয় জীবনে নতুন নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়েছে । তেমনি সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন সমস্যারও । তার ফলে , রাজনৈতিক জীবন ক্রমশঃ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে ।

আধুনিক রাষ্ট্র আকৃতি ও প্রকৃতি উভয় দিক দিয়েই গ্রীক নগর রাষ্ট্র থেকে পৃথক প্রকৃতির । এর সমস্যা বহু এবং জটিল । এই কারণে বর্তমান রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনা যুক্তিমূলক , সুসংবদ্ধ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া আবশ্যক । তাই অনেকে আলোচ্য শাস্ত্রটিকে ‘ রাষ্ট্রনীতি ’ অপেক্ষা ‘ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ’ বলার পক্ষপাতী । 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক

এখন ‘ রাষ্ট্রনীতি ’ বলতে ব্যবহারিক রাজনীতি বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় বা কলাকৌশলকে বোঝান হয় । পোলক রাষ্ট্রনীতিকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন – ( ১ ) তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতি ( Theoretical Politics ) এবং ( ২ ) ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি ( Practical Politics ) । 

তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতিতে রাষ্ট্র , সরকার , আইন ও সংযুক্ত অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তত্ত্বগত আলোচনা করা হয় । অপরদিকে , ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি হল ব্যবহারিকদিক মাত্র । রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পন্থা-পদ্ধতির আলোচনাই ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত হয় । বস্তুতপক্ষে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি বলতে যা বোঝায় তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র থেকে স্বতন্ত্র এবং সংকীর্ণ । শুধু রাষ্ট্রনীতি বলতে বর্তমানে এই ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতিকেই বোঝান হয় । বিভিন্ন দেশে , বিভিন্ন সময়ে , এমনকি একই দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতির পার্থক্য থাকে ।

কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনা সকল দেশেই সমান গুরুত্ব যুক্ত । তবে মতাদর্শগত বিচারে তত্ত্বগত আলোচনাতেও ভিন্ন ভিন্ন ঝোঁক দেখা যায় । ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত জ্ঞান নাও থাকতে পারে । ব্যবহারিক রাষ্ট্রনীতি ছাড়া তত্ত্বগত রাষ্ট্রনীতির বিষয়বস্তুও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত । সুতরাং রাষ্ট্রনীতির ধারণা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণা অধিকতর ব্যাপক । 

উপসংহার 

রাষ্ট্রনীতি ‘( Politics ) শব্দটি প্রধানতঃ প্রাত্যহিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের প্রবাহকেই বোঝায় । তাই অনেকে ‘ রাষ্ট্রনীতি ‘ শব্দটিকে আলোচ্য শাস্ত্রের পরিধির তুলনায় সংকীর্ণ মনে করেন । অধ্যাপক গার্ণার ‘ রাষ্ট্রনীতি ‘ শব্দটি ব্যবহারের বিরুদ্ধে । অনেকের মতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রনীতি নামে অভিহিত করার ক্ষেত্রে আপত্তি ওঠার সঠিক কোন কারণ নেই ।

গ্রীক পণ্ডিত অ্যারিস্টলের কথা বাদ দিলেও আধুনিক ব্রিটিশ পণ্ডিত হ্যারল্ড ল্যাস্কি ( Harold Laski ) লিখিত দুটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল An Introduction to Politics এবং A Grammar of Politics । মার্কিন লেখক লাওয়েল ( Harold Lassweld ) এরও একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল Politics : who gets what , when and how ?

অ্যারিস্টটল ও ল্যাস্কির গ্রন্থগুলির বিষয়সূচী বিচার করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে আলোচনাক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয় তার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে । তবে বাংলায় ‘ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ’ শব্দটি ‘ রাষ্ট্রনীতি ’ অপেক্ষা অধিক অর্থবহ মনে হয় ।

error: Content is protected !!