ইতিহাস

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয় 

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ছিলেন আফগানিস্তানের খিলজী জাতি গোষ্ঠীর লোক । তাঁর কোন বিশেষ বংশ মর্যাদা ছিল না । ভাগ্যান্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে তিনি গজনীতে আসেন ( ১১৯৫ খ্রীঃ ) । কিন্তু মহম্মদ ঘোরী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি দিল্লীতে উপস্থিত হন । কিন্তু এখানেও কুতুবউদ্দিন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে বদায়ুনে যান ।

বদায়ুনের শাসনকর্তা হিউবর উদ্দিন তাকে সেনাদলে নিয়োগ করেন । কিছুদিন পর তিনি অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসাম উদ্দিনের অধীনে চাকুরী নেন । হুসাম উদ্দিন তাকে চুনাগড়ের নিকটবর্তী দুটি পরগনার ইকতা দেন । বর্তমানে পরগনা দুটি ভাগবৃতভুইলী নামে পরিচিত । বখতিয়ার এখান থেকে পাশাপাশি অঞ্চলে নির্বিবাদে লুঠতরাজ চালিয়ে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতেন । তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ওদন্তপুরী , নালন্দা ও বিক্রমশীলার বৌদ্ধ মঠগুলি ।  

এরপর তিনি বিহার জয়ের পরিকল্পনা করেন । তখন উত্তর বিহারে কর্নাটের রাজবংশ রাজত্ব করত । তাই উত্তর বিহার আক্রমণ না করে তিনি অরক্ষিত দক্ষিণ বিহারে অভিযান চালান । লামা তারানাথের  মতে , বখতিয়ার দুর্গ মনে করে ওদন্তপুরী বিহারটিকে ধ্বংস করেন । এই অঞ্চলেই বখতিয়ার তাঁর কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখেন । বিভিন্ন স্থানে সেনা নিবাস স্থাপন করে তিনি নিজ কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন ।  

বিহার জয়ের পর বখতিয়ার দিল্লীর সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সাথে প্রচুর মূল্যবান উপঢৌকন সহ সাক্ষাৎ করেন ( ১২০৩ খ্রীঃ ) । আইবককে সন্তুষ্ট করে বখতিয়ার বাংলা অভিযানের সংকল্প করেন । তখন বাংলার শাসক ছিলেন সেন বংশীয় লক্ষ্মণ সেন । সেই সময় তিনি নবদ্বীপ প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন । বখতিয়ার প্রচলিত পথে অগ্রসর না হয়ে ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে দুর্গম পার্বত্য পথ ধরে নবদ্বীপে উপস্থিত হন ।  

মিনহাজ উদ্দিনইসামীর  বিবরণ থেকে জানা যায় , বখতিয়ার অশ্ব বিক্রেতার ছদ্মবেশে মাত্র আঠারো জন অনুচর নিয়ে নবদ্বীপে প্রবেশ করেন ( ১২০৪ খ্রীঃ ) । অশ্ব বিক্রেতা ভেবে রক্ষীরা তাকে প্রাসাদে প্রবেশে বাধা দেননি । প্রাসাদে ঢুকেই তিনিও অনুচরেরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে প্রাসাদবাসীদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করেন । বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণ সেন তখন মধ্যাহ্ন ভোজে বসেছেন । অপ্রস্তুত অবস্থায় আকস্মিক তুর্কী আক্রমণের সংবাদে হতবুদ্ধি রাজা কোন উপায়ন্তর না দেখে প্রাসাদের পশ্চাৎদ্বার দিয়ে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গ অভিমুখে রওনা হন এবং বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন । ইতিমধ্যে বখতিয়ারের পশ্চাৎ অনুসরণকারী অবশিষ্ট সৈন্যদলও নবদ্বীপে উপস্থিত হয়ে নদীয়া বিজয় সম্পূর্ণ করে ।  

আসলে তেলিয়াগড়ের পথ ধরে বিদেশী আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল বেশি । তাই লক্ষ্মণ সেন তেলিয়াগড়ে সৈন্য মোতায়েন রেখেছিলেন । নবদ্বীপ ছিল অরক্ষিত । তাছাড়া তুর্কী আক্রমণের ভয়ে অধিকাংশ মানুষ পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল । তাই মুসলমানের বঙ্গ বিজয় সহজ হয়ে গিয়েছিল । কারও কারও মতে , বখতিয়ারের নবদ্বীপ আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন ও অর্থলাভ । কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদারের  মতে , ‘ বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় তাঁর পরিকল্পিত রাজ্য জয়েরই অঙ্গ ছিল ।  

নবদ্বীপ বিজয়ের অল্পদিন পরে বখতিয়ার সসৈন্যে বাংলার রাজধানী লখনৌতি বা লক্ষণাবতী ( গৌড় ) আক্রমণ করেন । এক্ষেত্রেও তাকে বিশেষ বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি । পরবর্তী দু’বছর তিনি আর কোন রাজ্য জয়ে অগ্রসর হয়নি । সম্ভবত তাঁর রাজ্য পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী , পশ্চিমে কুশী নদী , উত্তরে পূর্ণিয়া ও দক্ষিণে গঙ্গা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল ।  

বঙ্গ বিজয়ের পরেই বখতিয়ার দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিনের কাছ থেকে শাসন পরিচালনার অনুমোদন লাভ করেন । অতঃপর তিনি বাংলার অভ্যন্তরীণ শাসন কাঠামো রূপায়ণে মনোনিবেশ করেন । বিজিত অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে তাঁর প্রধান অনুচরদের দায়িত্বে অর্পণ করেন । সীমান্ত অঞ্চলের প্রদেশগুলি তাঁর প্রিয় অনুচর আলিমদান ,হুসাম উদ্দিন আইওয়াজ প্রমুখের হাতে অর্পণ করেন । এই সব খিলজী মালিকরা প্রচুর ক্ষমতা ভাগে করতেন । এইভাবে বখতিয়ার খিলজী বাংলাদেশে মুসলমান প্রভুত্বের সূচনা করেন ।

error: Content is protected !!