বাহমনী সাম্রাজ্য
Contents
বাহমনী সাম্রাজ্য
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে সুলতানি প্রশাসনে বিভিন্ন রকম গোলযোগ দেখা যায় । এই ব্যাপারে দাক্ষিণাত্যের ‘ সাদাহ ’ আমীরদের বিরাট ভূমিকা ছিল । দক্ষিণ ভারতে শিক বা জেলা প্রশাসন ‘ আমীর-ই-সাদাহ ‘ বা সাদাহ আমীরদের উপর ন্যস্ত ছিল । এঁরা ছিলেন উচ্চশ্রেণীভুক্ত এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী । দক্ষিণের জনগণের উপর এঁদের বিশেষ কর্তৃত্ব ছিল । মহম্মদ বিন তুঘলক দেশদ্রোহীতার অপরাধে জনৈক সাদাহ আমীরকে হত্যার নির্দেশ দিলে সমস্ত সাদাহ আমীর সুলতানের উপর ক্ষুব্ধ হন ।
অতঃপর মহম্মদ বিন তুঘলক দক্ষিণ ভারতের প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করে সাদাহ আমীরদের ক্ষমতা খর্ব করতে উদ্যোগী হলে আমীরেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দৌলতাবাদ দখল করে ইসমাইল মুখ নামক জনৈক আমীরকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন ( ১৩৪৬ খ্রীঃ ) । কিন্তু ইসমাইল শাসনকার্যে অক্ষমতা হেতু নিজেই হাসান নামক আর একজন আমীরের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন । হাসান আলাউদ্দিন বাহমন শাহ ’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন ( ১৩৪৭ খ্রীঃ ) । এজন্য , তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ‘ বাহমনী বংশ ‘ নামে পরিচিত ।
বাহমান শাহ
বাহমান শাহ ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা ও শাসক । তিনি গোয়া , কানপুর , তেলেঙ্গানা প্রভৃতি জয় করেন । তাঁর রাজ্য উত্তরে ওয়েন গঙ্গা থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী এবং পূর্বে ভাঙ্গীর থেকে পশ্চিমে দৌলতাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । তিনি গুলবর্গায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন । শাসনের সুবিধার জন্য তিনি তাঁর রাজ্যকে চারটি তরফ বা প্রদেশে বিভক্ত করেন । এগুলি হল , গুলবর্গা , দৌলতাবাদ , বেরার ও বিদর । তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও প্রজাহিতৈষী শাসক । ১৩৫৮ খ্রীঃ তাঁর মৃত্যু হয় ।
বিজয়নগরের সাথে সংঘর্ষের সূচনা
বাহমান শাহ’র পর তাঁর পুত্র প্রথম মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন ( ১৩৫৮-৭৭ খ্রীঃ ) । তিনি ছিলেন যোগ্য শাসক ও সুযোদ্ধা । তাঁর আমল থেকেই আর এক দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য বিজয়নগর এর সাথে বাহমনী রাজ্যের দীর্ঘ সংঘাত শুরু হয় । মূলত কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রার মধ্যস্থিত রায়চুর দোয়াবের উর্বর ভূখণ্ডে আধিপত্য স্থাপনের জন্যই এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় । মুহম্মদ শাহ বিজয়নগরকে পরাজিত করে প্রচুর ক্ষতিপূরণ লাভ করেন । পরবর্তী সুলতান মুজাহিদ শাহও ( ১৩৭৭-৭৮ খ্রীঃ ) বিজয়নগর আক্রমণ করেন কিন্তু আনেগুণ্ডি দুর্গ দখল করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন । অতঃপর সিংহাসনে বসেন দ্বিতীয় মুহম্মদ শাহ ( ১৩৭৮ – ‘৯৭ খ্রীঃ ) । তিনি যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষপাতী ছিলেন না । শিল্প ও সাহিত্যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল ।
ফিরোজ শাহ
পরবর্তী সুলতান ফিরোজ শাহ ( ১৩৯৭-১৪২২ খ্রীঃ ) ছিলেন বাহমনী রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান । তাঁর আমলে পুনরায় বিজয়নগরের সাথে বাহমনী রাজ্যের সংঘর্ষ শুরু হয় । বিজয়নগর রাজ দ্বিতীয় হরিহর রায়চুরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন । ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে এই সন্ধি ভঙ্গ করে বিজয়নগর আবার বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করে , কিন্তু এবারেও পরাজিত হয়ে অপমানজনক সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয় । প্রচুর আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াও বিজয়নগরের রাজকন্যাকে ফিরোজের হাতে অর্পণ করা হয় । কিন্তু পরবর্তী যুদ্ধে তিনি বিজয়নগরের কাছে পরাজিত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন ।
যুদ্ধবিগ্রহের সাথে সাথে ফিরোজ বাহমনী রাজ্যের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে উদ্যোগী হন । তিনি দেশ বিদেশের পণ্ডিতকে তার রাজসভায় আমন্ত্রণ জানান । দিল্লী সুলতানির পতনোন্মুখ অবস্থার দরুন বহু পণ্ডিত দিল্লী থেকে এখানে চলে আসেন । ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত । ধর্ম বিষয়েও তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল । তিনি ছিলেন সবার কবি । তিনি মুখেমুখেই কবিতা রচনা করতে পারতেন । বিভিন্ন ভাষায় ছিল তাঁর সমান দক্ষতা ।
তিনি জ্ঞানী সভাসদ , ইতিহাসবিদ , ধর্মগুরু , কবি-সাহিত্যিক প্রমুখের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনায় মগ্ন থাকতেন । খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেলও তিনি পাঠ করেছিলেন । সকল ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর শ্রদ্ধাবোধ । তিনি বহু হিন্দুকে শাসন কাজে নিযুক্ত করেছিলেন । তাঁর আমল থেকেই শাসন কাজে বিশেষ করে রাজস্ব প্রশাসনে দক্ষিণী ব্রাহ্মণরা বিশেষ প্রাধান্য পেতে শুরু করেন । জোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য তিনি দৌলতাবাদে একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন ।
আহম্মদ শাহ
বৃদ্ধ বয়সে ফিরোজ এক গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হন এবং শেষ পর্যন্ত তার ভ্রাতা আহম্মদ শাহ ফিরোজকে সিংহাসনচ্যুত করে বাহমনী রাজ্যের সুলতান হন ( ১৪২২ ‘৩৫ খ্রীঃ ) । সিংহাসনে বসেই তিনি রাজ্যের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন । নিরাপত্তার প্রয়োজনে তিনি গুলবর্গা থেকে বিদরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । তাঁর আমলে বিজয়নগর রাজ দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করে পরাজিত হন এবং বার্ষিক কর দানের শর্তে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হন । এরপর তিনি বরঙ্গল দখল করেন । মালব ও গুজরাটের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযান রচনা করেন এবং জয়লাভ করেন । আহম্মদ শাহ ছিলেন ধর্মান্ধ , তবে বিদ্বান ব্যক্তির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল ।
আহম্মদ শাহর রাজত্বকালে তাঁর দরবারে অভিজাতদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী দুটি দলের সৃষ্টি হয়েছিল । একদিকে ছিল সুন্নিপন্থী স্থানীয় দক্ষিণী মুসলমানগণ এবং অন্যদিকে ছিল তুর্কী , পারসিক , আরবীয় প্রভৃতি বহিরাগত মুসলমানগণ । এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে বাহমনী শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল ।
দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ
আহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন ( ১৪৩৫-৫৭ খ্রীঃ ) । সিংহাসনে বসেই তিনি খান্দেশ ও কোঙ্কনের বিদ্রোহ দমন করেন । তার সময়ে বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায় রায়চুর দোয়াব আক্রমণ করেন । কিন্তু দেবরায় পরাজিত হন এবং করদানে প্রতিশ্রুত হন । তিনি বেশ কিছু প্রজাকল্যাণমূলক কাজ করেন । শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল ।
পরবর্তী শাসক হুমায়ুন শাহ ( ১৪৫৭-৬১ খ্রীঃ ) ছিলেন অকর্মণ্য ও অত্যাচারী । এজন্য জনগণ তাকে জালিম ( oppressor ) নামে অভিহিত করেন । হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র নিজাম শাহ সিংহাসনে বসেন ( ১৪৬১-৬৩ খ্রীঃ ) । তাঁর নাবালকত্বের সুযোগে উড়িষ্যা ও তেলেঙ্গনার রাজারা বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন । তিনি অকালে মারা গেলে সিংহাসনে বসেন তাঁর ভ্রাতা তৃতীয় মহম্মদ শাহ । তিনিও ছিলেন বিলাস প্রিয় , নৈতিক চরিত্রহীন ও অযোগ্য শাসক , কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ে মামুদ গাওয়ান নামক জনৈক দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মন্ত্রীর উত্থান ঘটে ।
বাহমনী সাম্রাজ্যের ভাঙন
মহম্মদ শাহ’র মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র মামুদ শাহ । তিনিও ছিলেন অদক্ষ । সেই সময়ে দক্ষিণী ও বহিরাগত অভিজাতদের দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে । বাহমনী রাজ্যের শেষ সুলতান ছিলেন কলিমুল্লাহ শাহ । তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ( ১৫২৭ খ্রীঃ ) বাহমনী রাজ্যের পতন ঘটে । অতঃপর বাহমনী রাজ্যের ধ্বংস স্তুপের উপর পাঁচটি স্বাধীন মুসলমান রাজ্যের উত্থান ঘটে । এগুলি হল , ( ১ ) বিজাপুরে আদিল শাহী রাজ্য , ( ২ )আহম্মদনগরে নিজাম শাহী রাজ্য , ( ৩ ) গোলকুণ্ডায় কুতুবশাহী রাজ্য , ( ৪ ) বেরারে ইমাদশাহী রাজ্য এবং ( ৫ ) বিদরে বারিদশাহী রাজ্য ।
বাহমনী সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা
বাহমনী রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ছিল অনেকাংশে দিল্লীর সুলতানি রাজত্বের শাসন ব্যবস্থার অনুরূপ । সমগ্র রাজ্য চারটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল । প্রতিটি প্রদেশে একজন করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন । প্রদেশগুলি বিভক্ত ছিল তরফে । তরফদার ছিলেন এর শাসনকর্তা । প্রাদেশিক শাসকগণ প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন । ফলে বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় । সরকারি কোষাগারে আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব । অধিকাংশ সুলতানই ছিলেন অকর্মণ্য ও অত্যাচারী । ফলে সামগ্রিক প্রশাসন ছিল দুর্বল । বাহমনী রাজ্যে প্রজা সাধারণের অবস্থা খুব ভাল ছিল না ।
রুশ পর্যটক নিকিতন এর বিবরণ থেকে জানা যায় , বাহমনী রাজ্যে জনগণের অবস্থা ছিল শোচনীয় । তবে অভিজাতগণ ছিলেন ধনী ও ক্ষমতাশালী । আমীর ওমরাহদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সুলতানের থেকে কোন অংশেই কম ছিল না । কৃষি ব্যবস্থা উন্নত ছিল , কিন্তু কৃষকদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ । সুলতানদের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড ধর্মান্ধতার বিষ বাষ্পে আচ্ছাদিত ছিল । স্মিথের মতে , বাহমনী রাজ্য দেশের উন্নয়নে কতটুকু করেছে তা পরিমাপ করা খুবই কঠিন ।