সুলতানি যুগের শাসন ব্যবস্থা

সুলতানি যুগের শাসন ব্যবস্থা  

দাস বংশের প্রতিষ্ঠাকাল ( ১২০৬ খ্রীঃ ) থেকে  লোদী বংশের পতন ( ১৫২৬ খ্রীঃ ) পর্যন্ত সময় ভারত ইতিহাসে ‘ সুলতানি যুগ ‘ নামে অভিহিত হয় । ভারত ইতিহাসে সুলতানি শাসন ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় । রাজত্বের প্রথম একশত বছর সুলতানেরা মোটামুটিভাবে রাজ্য বিস্তার ও নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিলেন । স্বাভাবিকভাবে ঐ সময়ে পরিকল্পিত শাসন কাঠামো তৈরির কাজে তারা মনোনিবেশ করতে পারেননি । তখন শাসন ব্যবস্থা চরিত্রগতভাবে ছিল সামরিক । খলজী বংশের আমলে দিল্লী সুলতানির ভিত্তি অনেকটা সুদৃঢ় হয়ে যায় । তাই ঐ সময় থেকেই সুলতানেরা অসামরিক শাসন কাঠামো গঠনে তৎপর হন । সমগ্র শাসন ব্যবস্থা মূলত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক — এই দু’ভাগে বিভক্ত ছিল । 

সুলতানি যুগের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা 

কেন্দ্রীয় তথা সমগ্র শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ছিলেন সুলতান স্বয়ং । সুলতান পদে প্রধানত দু’ভাবে নিয়োগ হত , যথা— ( ১ ) উত্তরাধিকার সূত্রে জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনে বসতেন । এবং ( ২ ) যোগ্যতার ভিত্তিতে বা প্রয়োজনে সুলতান পদে নিয়োগ অভিজাতগণ সুলতান পদে নিয়োগে হতেন । অভিজাতদের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক গোলযোগও সৃষ্টি হত ।  

সুলতান ছিলেন আইন , বিচার ও প্রশাসনের প্রধান । আইনত খলিফার প্রতিনিধি হলেও , সুলতান ছিলেন অপ্রতিহত ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী । প্রজাদের ধন মান রক্ষা করা ছিল তাঁর দায়িত্ব । সুলতানেরা ইসলামী শরিয়তি আইনকে মর্যাদা দিতেন। শরিয়তের ব্যাখ্যার দায়িত্ব উলেমাদের হাতে থাকলেও চূড়ান্ত ক্ষমতা সিদ্ধান্ত নিতেন সুলতান । শাসন পরিচালনার জন্য সুলতান বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করতেন । কর্মী নিয়োগ ও বাতিলের প্রধান মাপকাঠি ছিল সুলতানের ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দ ।  

পারসিক রীতি অনুযায়ী চারটি মন্ত্রকের উপর শাসন কার্য ভাগ করে দেওয়া ছিল । যথা — উজীর , আরিজ-ই-মামালিক , দিওয়ান-ই-ইনশা এবং দিওয়ান-ই-রিয়াস । এই পদগুলির মধ্যে ‘ উজীর ’ ছিলেন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । উজীর ছিলেন রাজা ও প্রজার মধ্যে প্রধান যোগসূত্র । রাজস্বের গোটা ব্যাপারটা উজীর দেখাশোনা করতেন । সাধারণত অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকেদের এই পদে নিয়োগে করা হত । উজীর প্রশাসনেরও প্রধান ছিলেন । তাই তাকে প্রধানমন্ত্রীও বলা হত । রাজার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কর্মচারী নিয়োগ ও বিচার করতেন । অনেক সময় তাকে সামরিক দায়িত্বও বহন করতে হত ।  

আরিজ-ই-মামালিক এর প্রধান কাজ ছিল সেনাবাহিনী সংগঠিত করা । সেনাবাহিনীতে নিয়োগ , বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা , নিযুক্ত সৈন্যদের দক্ষতা যাচাই করা , যুদ্ধরত বাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ করা এবং লুণ্ঠিত সম্পদের তত্ত্বাবধান করাও তার দায়িত্ব ছিল । যোগাযোগ দপ্তরের প্রধান ছিলেন দিওয়ান-ই-ইনশা । তিনি বিভিন্ন সরকারি আদেশের খসড়া প্রস্তুত করতেন । বিভিন্ন দপ্তরে নিদের্শ প্রেরণও তাঁর দায়িত্ব । তাঁকে সাহায্য করত ‘ দচির ’ নামক কর্মচারী । দিওয়ান-ই-রিয়াসৎ এর প্রধান কাজ ছিল বাজার নিয়ন্ত্রণ করা । রাজাকে নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ বজায় রাখা , মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা প্রভৃতি তার দায়িত্ব ছিল । 

উপরিলিখিত চারটি মন্ত্রক ছাড়াও একাধিক দপ্তর ছিল । এগুলিতে একজন প্রধান দায়িত্বে থাকতেন । যেমনㅡ সদর-উ-সুদূর ছিলেন ধর্মীয় ও দাতব্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত , প্রধান সদরের অধীনে প্রদেশ ও জেলায় সদর থাকত । বিচার দপ্তর পরিচালনা করতেন প্রধান কাজী । তার অধীনে অন্যান্য কাজীরা বিচার পরিচালনা করতেন । বিচার কাজে সহায়তা করতেন ‘ মুফতী ‘ নামক কর্মীরা । এ ছাড়া দিওয়ান-ই-আমীর কোহী বা কৃষি দপ্তর ; দিওয়ান-ই-ইস্তেফাক বা সরকারি পেন্সন দপ্তর ; বারিদ-ই-মামালিক বা গুপ্তচর বিভাগ ; দিওয়ান-ই-মুস্তাকারাজ বা কৃষিঋণ দপ্তর প্রভৃতি একাধিক দপ্তর ছিল । 

শহরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল ‘ কোতোয়াল ’ নামক কর্মচারীদের হাতে । শহরে আগত বিদেশীদের কার্যকলাপও তিনি দেখতেন । কোতোয়ালের অধীনে পুলিশ বাহিনী থাকত । মুহতাসিব নামক কর্মীরা কোতোয়ালকে সাহায্য করতেন । গ্রামাঞ্চলে গ্রামরক্ষী বাহিনী ও গ্রামসভা শান্তিরক্ষা করত । 

সুলতানি যুগের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা 

সুলতানি যুগে শাসন ব্যবস্থা সবসময় একই রকম ছিল না । আলাউদ্দিন খলজীর আগে পর্যন্ত দূরবর্তী অঞ্চলগুলো ‘ মাকতি ‘ বা ইকতাদারদের অধীনে ন্যস্ত থাকত । সুলতান সাধারণত ইকতাদারদের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না ; ইকতাদাররা নিজ নিজ এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন এবং রাজস্ব আদায় করতেন । সুলতানকে প্রাপ্য রাজস্ব প্রদানের শর্তে তারা স্বাধীনতা ভাগে করতেন । সুলতানের প্রয়োজনে তারা সৈন্যও সরবরাহ করতেন ।  

আলাউদ্দিনের সময় থেকে প্রাদেশিক শাসনে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে । তিনি বহু নতুন অঞ্চল জয় করেন । ওয়ালি এবং ঐসব অঞ্চলে ওয়ালি বা মালিক নামক শাসক নিযুক্ত করেন । তাই ঐ সময় থেকে ‘ ইকতাদার ’ ও ‘ ওয়ালি ‘ এই দু’ধরনের প্রাদেশিক শাসন চালু হয় । ওয়ালিরা ইকতাদারদের মতই নিজ নিজ অঞ্চলের সামরিক ও বেসামরিক সমস্ত কাজ , রাজস্ব আদায় প্রভৃতি করতেন । উদ্বৃত্ত অর্থ তারা সুলতানের কাছে পাঠাতে বাধ্য থাকতেন ।  

মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল থেকে প্রাদেশিক শাসন আরও সুসংহত হয় । ঐ সময়ে সাম্রাজ্য সীমা অনেক বেড়ে যাওয়ার ফলে কোন কোন প্রদেশকে শিক বা জেলায় বিভক্ত করা হয় । শিকের দায়িত্ব ছিল শিকদার নামক কর্মচারীর উপর । শিকগুলিকে আবার ‘ পরগনা ’ নামক আরও ছোট ভাগে বিভক্ত করা হয় । রোমিলা থাপারের  মতে , পরগনার প্রধান ছিলেন মুনসেফ নামক কর্মচারী । তাকে সাহায্য করত খুৎ , চৌধুরী নামক অন্যান্য কর্মীরা ।  

পরগনাগুলি ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি । স্থানীয় গ্রামগুলিতে এক ধরনের স্বায়ত্ত শাসন চালু ছিল । গ্রামে ‘ চৌকিদার’ ও পাটোয়ারী ’ নামক কর্মীর নাম পাওয়া যায় । চৌকিদার ছিলেন শান্তি রক্ষক এবং পাটোয়ারী রাজস্ব আদায়ের ভার প্রাপ্ত । এখানে ‘ গ্রাম সভা ‘ নামক এক শ্রেণীর পঞ্চায়েত ছিল , যারা লোকায়ত সরকারের ক্ষমতা ভাগে করত । এইভাবে মধ্যযুগে ভারতে স্থানীয় শাসনের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় ।

error: Content is protected !!