ইতিহাস

সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি

Contents

সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি 

সুলতানি আমলে ভারত রাষ্ট্রের প্রকৃতি কি ছিল , এই বিষয়ে বিতর্ক আছে । ঐতিহাসিকেরা সুলতানি শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে এই বিতর্ককে আকর্ষণীয় করেছেন । ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ , এ. এল শ্রীবাস্তব প্রমুখ আপাতভাবে সুলতানি রাষ্ট্রকে ইসলামীয় ধর্ম রাজ্য ( Islamic Theocracy ) বলে অভিহিত করেছেন । 

ঈশ্বরী প্রসাদের  মতে , সুলতানদের সীমাহীন ক্ষমতা অবশ্যই ছিল । প্রশাসনিক ও ধর্মীয় বিষয়ে সুলতান ছিলেন সর্বেসর্বা । কিন্তু সুলতানরা শরিয়তের নির্দেশ লঙ্ঘন করতে পারতেন না । শরিয়ত বা ধর্মশাস্ত্রের বিধান ছিল সুলতানি আমলের নীতি নির্ধারণের মাধ্যম । উলেমাদের চিন্তা ভাবনাকে মর্যাদা দিতে শাসককুল দায়বদ্ধ ছিলেন । মধ্যযুগের সুলতানগণ ইসলামের অনুশাসনগুলিকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে তাদের শাসন পরিচালনা করতেন বলে উপরিউক্ত ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ।  

অন্যদিকে সতীশচন্দ্র , মহম্মদ হাবিব প্রমুখ অনেকেই এর বিপরীত মত পোষণ করেন । এঁদের মতে , সুলতানি রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে ধর্মাশ্রয়ী বা পুরোহিত তান্ত্রিক ছিল না । ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই ভারতের সুলতানি আমলে হয় অনুপস্থিত ছিল , অথবা লঙ্ঘিত হয়েছিল । এই গোষ্ঠীর মতে , সুলতানি রাষ্ট্র ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ ও অভিজাত তান্ত্রিক । 

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র কি 

এই বিতর্কের সমাধানে পৌছানোর জন্য ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা প্রয়োজন । সেই সঙ্গে ইসলামের ধর্ম তত্ত্ব সুলতানি আমলে কতখানি বা কিরূপে প্রযুক্ত ছিল তাও জানা দরকার । দেবতান্ত্রিক বা ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হল এমন রাষ্ট্র যা দেবতা বা যাজক শ্রেণীর দ্বারা পরিচালিত হয় । এই ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল— 

( ১ ) সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী । 

( ২ ) মানুষ নির্দিষ্ট আইনবিধির পরিবর্তে ঈশ্বরের নির্দেশ আইন হিসেবে প্রযুক্ত হয় । 

( ৩ ) অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদন করেন । এই প্রেক্ষাপটে মধ্যযুগীয় ভারতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিচার করা যেতে পারে ।  

খলিফার প্রতি আনুগত্য 

খলিফা ছিলেন ইসলাম জগতের সর্বোচ্চ পুরুষ । তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মগুরু ও শাসক । খলিফা শরিয়তের ভিত্তিতে মুসলমান জগতকে পরিচালনা করার জন্যে দায়বদ্ধ । অন্যদিকে ইসলামীয় আইন অনুসারে খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রতিটি মুসলমানের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক । সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে । 

প্রথমে হজরত মহম্মদ এবং তাঁর তিরোধানের পর খলিফা ইসলামীয় রাষ্ট্রমণ্ডলের সর্বোচ্চ পরিচালক । অন্যান্য শাসকেরা কখনই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন । তাঁরা খলিফার নায়েব মাত্র । বাস্তবক্ষেত্রে দিল্লীর সুলতানরাও নিজেদেরকে খলিফার ভৃত্য বলে মনে করতেন । দুই-একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ছাড়া অধিকাংশ সুলতানই ইসলামীয় আদর্শ অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করতেন । সুলতানরা খলিফাকে নিজেদের ‘ প্রভু ‘ বলে গণ্য করতেন । একমাত্র আলাউদ্দিন খলজী ছাড়া সকলেই নিজ নিজ পদের স্বীকৃতি হিসেবে খলিফার ফরমান গ্রহণ করেন ।  

ইলতুৎমিস ১২২৯ খ্রীষ্টাব্দে খলিফার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতিপত্র ( মনসুর ) লাভ করেন । গিয়াস উদ্দিন বলবন নিজেকে খলিফার সহকারী হিসেবে অভিহিত করে গর্ববোেধ করতেন । ১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দে বাগদাদে খলিফা তন্ত্রের অবসান ঘটলেও ভারতের সুলতানরা খলিফার প্রতি আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করার সাহস দেখাননি । খলিফার অবর্তমানেও দিল্লীর সুলতানরা নিজেদের খলিফার সহকারী বা ইয়ামিন-উ-খলিফা বলে অভিহিত করতেন , তাদের মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করতেন বা খলিফার নামে ‘ খুৎবা ‘ পাঠ করতেন । 

মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজত্বের প্রথমদিকে তাঁর মুদ্রা থেকে খলিফার নাম বাদ দেন । কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে বিব্রত সুলতান পরিশেষে মুদ্রায় খলিফার নাম পুনঃপ্রবর্তন করেন । ফিরোজ তুঘলকও একাধিকবার দূত প্রেরণ করে মিশরের বসবাসকারী খলিফার বংশধরের অনুমোদন পত্র সংগ্রহ করেন ।  

উলেমাদের কর্তৃত্ব 

মুসলিম শাসনরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শাসন কার্যে উলেমা শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ । কোরানের ব্যাখ্যাকার হিসেবে এই শিক্ষিত ও ধর্মবিদ শ্রেণী ইসলামিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ মর্যাদা ও কর্তৃত্বের অধিকারী । সুলতানি আমলের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উলেমাদের ভূমিকাও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ । তারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন , উলেমারা মূল ইসলামী আইন শরিয়ত ব্যাখ্যা করতেন এবং সুলতান তা মান্য করতেন । শাসন ব্যাপারে উলেমাদের প্রভাব ছিল অপ্রতিহত । বিচার ও প্রশাসনের অধিকাংশ পদে উলেমারা নিয়োজিত হতেন ।  

উলেমারা আশা করতেন যে , সুলতানরা শরিয়তের বিধান মেনে বিধর্মীদের দেশকে ( দার-উল-হারব ) ইসলামের পবিত্র ভূমিতে ( দার-উল-ইসলাম ) পরিণত করবেন । উলেমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সুলতানদের পক্ষেও আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায় । ফলে সুলতানরা উলেমাদের ভূমিদান করতেন । মসজিদ নির্মাণ করতেন এবং উলেমাদের সন্তুষ্টির জন্য মাঝেমাঝেই হিন্দুদের দেবমূর্তি ও মন্দির ধ্বংস করে নিজেদের বিরোধী ভাবমূর্তি তুলে ধরতেন । 

বিরুদ্ধ মত 

খলিফার স্বীকৃতিপত্র পাওয়ার জন্য , কিংবা প্রশাসনের উলেমাতন্ত্রের উপর নির্ভরতার কারণে অনেকেই সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন । কিন্তু এর বিরোধীদের বক্তব্য বেশ জোরালো এবং তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য । কে. এম. আশরাফ , ড. মুজিব ,সতীশচন্দ্র প্রমুখ ইতিহাসবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ঘটনা পরম্পরা বিচার করে প্রমাণ করেছেন যে ভারতে সুলতানি রাষ্ট্র আদৌ ধর্মাশ্রয়ী ছিল না । সমকালীন লেখক জিয়াউদ্দিন বরণী  ফুতুহ ই জাহান্দারি গ্রন্থে সুলতানির রাষ্ট্র দর্শন সম্পর্কে যে মানবিক , সার্বজনীন ও বাস্তবমুখী তত্ত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে ইসলামের রাষ্ট্র দর্শনের বহু অমিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব । যেমনㅡ  

প্রথমত , ইসলামীয় আইনবিধি শরিয়ত অনুযায়ী স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোন অবকাশ নেই । সেখানে ক্ষমতার সর্বোচ্চে আছেন ঈশ্বর , তাঁর পক্ষে প্রতিনিধি স্বরূপ পয়গম্বর ও পরে খলিফা । কিন্তু মধ্যযুগে ভারত ছিল একটি সম্পূর্ণ ও স্বতন্ত্র রাজতন্ত্র শাসিত অঞ্চল ।  

দ্বিতীয়ত , খলিফা তন্ত্রের প্রতি দিল্লীর সুলতানদের আনুগত্য ছিল বাহ্যিক । সুলতান বা প্রত্যেকেই ছিলেন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক । ব্যক্তিগত প্রতিভা বা উদ্যোগের দ্বারা এঁরা ক্ষমতা দখল করেছিলেন । এঁদের নিয়োগ বা পদচ্যুতি কিছুই খলিফার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল না । এঁরা কেউ কেউ খলিফার অনুমোদন গ্রহণ করেছিলেন সত্য কিন্তু তা ধর্মীয় আনুগত্যের জন্যে নয় , রাজনৈতিক প্রয়োজনের দাবিতে । এঁরা বুঝতে সক্ষম ছিলেন যে , খলিফার অনুমোদনের তকমা থাকলে ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের নৈতিক সমর্থন পাওয়া সম্ভব হবে । ধর্মানুগত্য নয় , রাজনৈতিক ভীতি থেকে তার এই কাজে আগ্রহী হয়েছিলেন । আলাউদ্দিন খলজীর মত সমর নায়ক বা মহম্মদ বিন তুঘলকের মত জ্ঞানী সুলতান খলিফার অনুমোদনের প্রত্যাশী ছিলেন না ।  

তৃতীয়ত , মধ্যযুগে সুলতানি রাষ্ট্রে উলেমারা এমন কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগে করতেন না , যার ভিত্তিতে সুলতানি রাষ্ট্রকে ‘ পুরোহিত তান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘ বলা যায় । উলেমারা ছিলেন কোরান ও শরিয়ত বিশেষজ্ঞ । রাষ্ট্রের ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে এঁরা সুলতানকে পরামর্শ দিতেন এবং বিচার বিভাগের কিছু লোভনীয় রাজপদ ভাগে করতেন । রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে তারা নির্দেশ দেবার অধিকারী ছিলেন না ।  

চতুর্থত , শরিয়তের বিধান নয় , সুলতানের নির্দেশনামা ( জাত্তবিৎ ) দ্বারা শাসন পরিচালনা করা হত । এমনকি শরিয়তের সিদ্ধান্তের বিরোধী নির্দেশ জারী করতেও সুলতানেরা দ্বিধা করতেন না । এছাড়াও শরিয়তের বহু ছোটখাট নির্দেশ সুলতানি আমলে ভঙ্গ করা হত । যেমন ইসলামের তত্ত্বানুযায়ী মুসলমানদের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক ছাড়া অন্যান্য সুলতানের আমলে শাস্তি হিসেবে মুসলিমদেরও প্রাণদণ্ড দেওয়া হত । শরিয়তে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল । কিন্তু সুলতানি আমলে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধির স্বার্থে ঋণদান ও সুদ গ্রহণ সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল । এইসব যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে , ভারতের সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রিত ছিল না ।  

মূল্যায়ন 

ভারতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসবিদের মত হল যে , এটি ছিল সামরিক ও অভিজাত তান্ত্রিক । ধর্ম , দর্শন বা প্রজা কল্যাণ — কিছুই নির্দিষ্ট রাষ্ট্রাদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়নি । সবই ছিল আপেক্ষিক । আসলে রাষ্ট্র ছিল সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাত গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন । সুলতান অস্ত্রবলে সিংহাসন দখল করতেন ও অস্ত্রবলেই তা রক্ষা করতেন । সুলতানের ব্যক্তিগত সামরিক দক্ষতার উপর নির্ভর করত তার স্থায়িত্ব । সুলতানি রাষ্ট্র ছিল একপ্রকার পুলিশী রাষ্ট্র , যার প্রধান কাজ ছিল শক্তির দ্বারা রাজ্য জয় , আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও রাজস্ব আদায় । এই কাজের জন্য সুলতানের একার ক্ষমতা যথেষ্ট ছিল না । তাই সুলতানরা একটি দক্ষ ও বিশ্বস্ত অভিজাত গোষ্ঠী গড়ে তোলেন ।

error: Content is protected !!