ইতিহাস

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে দিল্লীর সুলতানি সাম্রাজ্যে ভাঙন দেখা দেয় । আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠে নতুন নতুন স্বাধীন রাজ্য । সুলতানি সাম্রাজ্যের ভগ্ন স্তুপের উপরে এমনিভাবেই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে ।  

বিজয়নগর রাজ্যের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । অধ্যাপক সেওয়েল ( Sewell ) তাঁর বিখ্যাত ‘ A Forgotten Empire ‘ গ্রন্থে বিজয়নগরের উৎপত্তি সংক্রান্ত যে সাতটি কিংবদন্তীর উল্লেখ করেছেন , তার মধ্যে হরিহর ও বুক্কার কাহিনীই সর্বাধিক প্রচলিত । মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বহু দিন থেকেই দক্ষিণ ভারতীয় শাসকদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছিল । মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে এই ক্ষোভ প্রকাশ্য বিদ্রোহে রূপান্তরিত হয় । সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে এই হিন্দু প্রতিক্রিয়ার সুযোগে সঙ্গম নামক ব্যক্তির দুই পুত্র হরিহরবুক্কা তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণতীরে বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৩৩৬ খ্রীঃ ) ।  

কিংবদন্তী আছে যে ,মাধব বিদ্যারণ্য সায়নাচার্য নামক দুই হিন্দু পণ্ডিত মুসলিম আধিপত্যের বিরুদ্ধে হিন্দু সংস্কৃতি রক্ষার জন্য নতুন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠায় হরিহর ও বুক্কাকে সাহায্য করেন । অন্যদিকে ফাদার হেরাস , বি. পি. দেশাই প্রমুখের মতে , মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হোয়সল রাজ তৃতীয় বল্লাল । তাঁর অধীনস্থ সামন্ত রাজা ছিলেন হরিহর । তৃতীয় বল্লালের মৃত্যুর পর তাঁরই রাজ্যাংশে হরিহর বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।  

যাই হোক , সঙ্গম বংশীয় হরিহর ও বুক্কাই যে বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , এই বিষয়ে সন্দেহ নেই । বিজয়নগর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রায় দু’শত বছর টিকে ছিল । এই সময়ে চারটি রাজবংশ যথা — সঙ্গম , সালুভ ,তুলুভঅরবিডু বংশ বিজয়নগরে রাজত্ব করে ।

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থা

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থায় সম্রাট ছিলেন সর্বেসর্বা । তবে ধর্মের অনুশাসনে রাষ্ট্র কার্য পরিচালনার আদর্শ স্বীকৃত ছিল । রাজ কর্তব্য সম্বন্ধে কৃষ্ণদেব রায় মন্তব্য “ ধর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে রাজ্য শাসন করাই রাজার প্রধান কর্তব্য ।” একটি মন্ত্রি পরিষদ শাসন বিষয়ে সম্রাটকে সাহায্য করত । মন্ত্রীগণ সম্রাট কর্তৃক মনোনীত ও পদচ্যুত হতেন । সমাজের প্রথম তিনটি শ্রেণীর মধ্যে থেকে মন্ত্রী নিযুক্ত করা হত । সমগ্র রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল । প্রাদেশিক শাসন কর্তা ‘ নায়ক ‘ নামে পরিচিত ছিলেন ।  

রাজপরিবার বা অভিজাতদের মধ্য থেকে এঁদের রাজা মনোনীত করতেন । এঁদের নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকত । এঁরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন । প্রদেশগুলি জেলা এবং জেলাগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল । গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করত । এখানে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ছিল । গ্রামগুলি স্বায়ত্ত শাসনাধিকার ভোগ করত । মহানায়কাচার্য নামক কর্মচারীর মাধ্যমে রাজা গ্রামের অবস্থা তত্ত্বাবধান করতেন । সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব । রাজস্বের হার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের ছিল । ভূমি রাজস্ব ছাড়া বাণিজ্য কর , গোচারণ কর প্রভৃতি আদায় করা হত ।  

বিজয়নগরের শাসন ব্যবস্থার প্রধান ত্রুটি ছিল প্রাদেশিক শাসন কর্তা ও সামন্ত শ্রেণীর অবাধ ক্ষমতা । কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । তা ছাড়া , শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রসার না হওয়ার ফলে রাজকোষ দুর্বল হয়ে পড়েছিল । শেষের দিকের রাজারা সবাই ছিলেন অদক্ষ ও অযোগ্য । তাই এর পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল ।

error: Content is protected !!