বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা

একাধিক বিদেশী পর্যটক বিজয়নগর সাম্রাজ্যে পরিভ্রমণে এসেছিলেন । এঁদের মধ্যে পর্তুগীজ বণিক ও ভ্রমণকারী ফার্নাও নুনিজডােমিনগো পায়েজ , ইতালীয় পর্যটক নিকলোকন্টি , পারসিক আব্দুর রেজ্জাক প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য । এদের বিবরণী থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক  জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য জানা যায় । এইসব বিবরণীর ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকৃত । 

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অর্থনীতি

কৃষি : বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা জানা যায় । অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল কৃষি । জমিগুলি ছিল উর্বর । জমির মালিকানা ছিল ‘ নায়ক ’ বা ‘ জমিদারের‘ হাতে । চাষীরা ছিল ভাড়াটিয়া প্রজা । বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার রাজস্বের হার নির্দিষ্ট ছিল । ভূমিদাস প্রথা প্রচলিত ছিল । কৃষকদের অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না । মঠ , মন্দির দান গ্রহীতারাই ছিল জমির মালিক । প্রজারা মজুরির পরিবর্তে জমি চাষ করত । মঠ ও মন্দির কর্তৃপক্ষ সুদের বিনিময়ে কৃষকদের ঋণ দান করত । ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে জোতদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হত । ডােমিনগো পায়েজ  উল্লেখ করেছেন , শহরের বাজারে চাল , গম , খাদ্য শস্য , যব , কলাই , ডাল মজুদ থাকত এবং খাদ্যদ্রব্যের দাম ছিল খুব সস্তা । 

শিল্প বাণিজ্য : বিজয়নগরের ধাতু শিল্প , বস্ত্র শিল্প , মৃৎশিল্প বেশ উন্নত ছিল । বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্পীদের পৃথক সংঘ ( guild ) ছিল । সমাজে তন্তুবায় বা মৃৎশিল্পীর তুলনায় লৌহ শিল্পী বা কাষ্ঠ শিল্পীর উন্নত মর্যাদা ছিল । অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে বণিক সংঘ’গুলির বিশেষ ভূমিকা ছিল । বিজয়নগরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য চলত । পথঘাট ছিল উন্নত । গাড়ী , ঘোড়া বা বলদের পিঠে করে মাল পরিবহণ করা হত ।

আব্দুর রেজ্জাক এর বিবরণ থেকে জানা যায় , বিজয়নগরে প্রায় ৩০০ বন্দর ছিল । এইসব বন্দর থেকে পারস্য ও ইউরোপের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য চলত । রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে প্রধান ছিল কাপড় , চাল , লোহা , মসলা , গন্ধক প্রভৃতি । আরবী ঘোড়া , মুক্তা , চীনা ভেলভেট , রেশম প্রভৃতি আমদানি হত । এখানে বাণিজ্য করে পর্তুগীজ বণিকরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল । বিজয়নগরের সাথে চীন , মালয় , ব্রহ্মদেশ , আরব ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল । আব্দুর রেজ্জাক  বলেছেন , “ বিজয়নগরে প্রচুর হাতী , সোনা ও দামী পাথর মজুত ছিল । ” বাণিজ্য শুল্ক থেকে রাজকোষে ভালই অর্থাগমত হত । 

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক অবস্থা 

বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগরের সমাজ জীবনের বিস্তৃত ইতিহাস জানা যায় । জাতিভেদ ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত একটি প্রথা । জাতিভেদের ভিত্তিতে রাজ্য শাসন করাকে রাজকর্তব্য বলে মনে করা হত । ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের ছিল সামাজিক প্রাধান্য । এদের কর্মবিভাগ পূর্বের মতই ছিল । তবে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অবাধ মেলামেশায় কোন বাধা ছিল না।  

পর্তুগীজ কর্মচারী বারবোসার বিবরণ থেকে জানা যায় , গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য ছিল , মুসলমান ছিল খুবই কম । সমাজে নারীদের বিশেষ মর্যাদা ছিল । বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করতেন । মল্ল বিদ্যা , অসি যুদ্ধ প্রভৃতি নারীদের আয়ত্তাধীন ছিল । এছাড়া নারীরা কারুশিল্প , সঙ্গীত , সাহিত্য প্রভৃতি চর্চা করতেন । গঙ্গা দেবী , তিরুমালাম্মা সে যুগের নামকরা কবি ছিলেন ।  

নুনিজের বিবরণ থেকে জানা যায় , বিজয়নগরে নারী দ্বার রক্ষিণী নিয়োগে করা হত । তবে নারী জীবনে কিছু অন্ধকার দিকও ছিল । যেমন , পুরুষেরা বহুবিবাহে আসক্ত ছিল । সতীদাহ প্রথাও বেশ ব্যাপক ছিল । বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথার অভিশাপও ছিল । সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বিশেষ প্রভাব ও ক্ষমতা ছিল । ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্র ছাড়াও রাজনীতিতে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য ছিল । তবে এরা দৈহিক শ্রম করতেন না , নুনিজ বলেছেন , “ ব্রাহ্মণদের মেধার তীক্ষ্ণতা , হিসাব রক্ষার দক্ষতা , দৈহিক কৃশতা ও কঠিন শ্রমে অপারগ ” পরিলক্ষিত হত । ব্রাহ্মণরা নিরামিষাশী ছিলেন । তবে সাধারণ লোকে আমিষ ভক্ষণ করতেন । চাল , গম , ফলমূল প্রভৃতি ছিল প্রধান খাদ্য । সেযুগে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিদ্যমান ছিল ।  

error: Content is protected !!