মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্ব
Contents
মহম্মদ বিন তুঘলকের কৃতিত্ব
মধ্যযুগের ইতিহাসে সর্বাধিক বিতর্কিত চরিত্র মহম্মদ বিন তুঘলক । ঐতিহাসিকগণ তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বহু পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করেছেন । কারও কারও মতে , তিনি ছিলেন সৎ , দয়ালু , ন্যায় নিষ্ঠ ও প্রজাদরদী শাসক । আবার অনেকের মতে , তিনি ছিলেন খামখেয়ালী , উন্মাদ , স্বেচ্ছাচারী ও রক্তপিপাসু ।
ব্যক্তিগত গুণাবলী
মহম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্রে সদ গুণাবলীর অভাব ছিল না । এর আগে যত সুলতান দিল্লীর সিংহাসনে বসেছেন , ব্যক্তিগত গুণাবলীর বিচারে মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম । মহম্মদ বিন তুঘলকের পাণ্ডিত্য ও মেধা ছিল সর্বজনবিদিত । জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিকে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ । গণিত , দর্শন , জ্যোতির্বিদ্যা , তর্কশাস্ত্র , কাব্য প্রভৃতি সব বিষয়েই তাঁর গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল । তাঁর হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর । গ্রীক দর্শনের প্রতি আগ্রহবশত তিনি যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেন । বিভিন্ন ধর্মবিষয়ে তার জ্ঞান এত গভীর ছিল যে , উলেমারা তার সঙ্গে ধর্মালোচনা করতে ভয় করত । পূর্ববর্তী সুলতানদের বহু কু অভ্যাস থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন । সাধারণভাবে তিনি ছিলেন দয়ালু , দানশীল ও প্রজাদরদী ।
রাজনৈতিক আদর্শ
মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল সারা ভারতের একত্রীকরণ । উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে একই শাসনের অঙ্গীভূত করার জন্য তিনি উভয় বিভাগের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাধাগুলি দূর করতে সচেষ্ট ছিলেন । নিজামী মনে করেন , সম্রাট অশোকের পর কোন শাসকই সমগ্র ভারতকে এক দেশ হিসেবে দেখেননি । তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ভারতের বাইরে পূর্বে চীন , খোরাসান থেকে পশ্চিমে মিশর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল ।
মহম্মদ তুঘলকের চরিত্রের প্রধান সীমাবদ্ধতা হল ধৈর্য্যের অভাব । কারো পরামর্শ গ্রহণ করতেও তিনি চাইতেন না । ধৈর্য হীনতার শিকার হয়েই তিনি নিষ্ঠুর হয়ে উঠলেন । বারণীর মতে , প্রতিদিনই সুলতানের প্রাসাদ থেকে মৃতদেহ বের করা হত । তিনি বিদ্রোহী বাহাউদ্দিনের মাংস রান্না করে তাঁর আত্মীয়দের খেতে বাধ্য করেছিলেন । আসলে শাস্তিদানের সময় অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করতেন না । এই কারণে বারণী তাকে ‘ রক্ত পিপাসু ও নিষ্ঠুর ’ বলে বর্ণনা করেছেন ।
সার্বিক ব্যর্থতা
মহম্মদ তুঘলকের প্রায় সবগুলি পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল । সদ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হলেও নানা অসামঞ্জস্যতার কারণে সেগুলি ব্যর্থ হয় । যেমন—
( ১ ) সুলতানের ব্যবহারিক বুদ্ধি ও ধৈর্যের অভাব ছিল ।
( ২ ) তাঁর পরিকল্পনাগুলি ছিল অতিমাত্রায় যুগ অগ্রণী । তাঁর চিন্তা ভাবনার সাথে খাপ খাওয়ানো তাঁর কর্মচারী বা প্রজাসাধারণের অসাধ্য ছিল ।
( ৩ ) স্বার্থান্বেষী ও ক্ষমতালোভী উলেমা সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধভাবে সুলতানের বিরোধিতা করে তাঁর প্রকল্পগুলিকে ব্যর্থ করে দেয় ।
( ৪ ) রাজকর্মচারীদের কাছ থেকেও তিনি উপযুক্ত সহায়তা পাননি । এক্ষেত্রে স্বয়ং সুলতানের দায়িত্ব ছিল বেশি ।
( ৫ ) সর্বোপরি সুলতানের অস্থিরতা অন্তদৃষ্টির অভাব ও ধৈর্যহীনতা তাঁর পরিকল্পনা সমূহকে বিফল করেছিল ।
সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনে মহম্মদ বিন তুঘলকের দায়িত্ব
দিল্লী সুলতানির পতনের জন্য অনেকে মহম্মদ তুঘলকের কার্যাবলীকে দায়ী করেছেন । তাঁর একাধিক ব্যয়বহুল ও ব্যর্থ পরিকল্পনার জন্য রাজকোষ শূন্য হয়ে গিয়েছিল । এই আঘাত সুলতানি সাম্রাজ্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি । তা ছাড়া , সাম্রাজ্য শাসনে তাঁর অক্ষমতার ফলে বহু প্রদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল । ফলে সাম্রাজ্যের আয়তন ছোট হয়ে পড়ে ।
বিশেষত দক্ষিণ ভারতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ । ঐ অঞ্চলকে প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আনতে গিয়ে তিনি বিরাট ভুল করেছিলেন । অতিরিক্ত কঠোরতা দ্বারা তিনি কোন বিদ্রোহই দমন করতে পারেননি , পরন্তু আমীর , ওমরাহ থেকে সাধারণ মানুষ সবাই সুলতানি শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল । হতাশার মাঝে তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন ‘ আমার রাজ্য অসুস্থ , কোন চিকিৎসাই তাকে সুস্থ করতে পারছে না ‘।
অনেকের মতে , সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মহম্মদ তুঘলকের দায়িত্বকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে । এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে , তাঁর আমলেই সুলতানি সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটেছিল । ঐ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব উন্নত ছিল না । ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদের জাগরণ ও প্রসার ছিল স্বাভাবিক । তাঁর কৃতিত্ব এই যে , তিনি অধিকাংশ বিদ্রোহই দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । পরন্তু তার প্রাণনাশের কোন ষড়যন্ত্র হয়নি । কর্মচারীরা ও সৈন্যবাহিনী ছিল তাঁর অনুগত । তিনি ছিলেন সুযোদ্ধা এবং কর্মপরায়ণ । পতন প্রকৃতির নিয়ম । এজন্য তাকে এককভাবে দায়ী করা যায় না ।