মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা
Contents
মহম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনা
তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘ জুনা খাঁ ’ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন ( ১৩২৫ খ্রীঃ ) । জুনা খাঁ ই ইতিহাসে ‘ মহম্মদ বিন তুঘলক ‘ নামে খ্যাত । অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা , জুনা খাঁ ই ষড়যন্ত্র করে গিয়াসুদ্দিনকে হত্যা করেছিলেন ।
পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রবণতা
ভারতের মুসলমান শাসকদের মধ্যে সম্ভবত মহম্মদ বিন তুঘলক সব থেকে বিতর্কিত চরিত্র । এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী স্বীকারই করেছেন যে , বহু চেষ্টা করেও তিনি সুলতানকে সমগ্রভাবে বুঝে উঠতে পারেননি । সিংহাসনে বসে তিনি একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন , যার অধিকাংশই ছিল মৌলিক ও ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী । কিন্তু এগুলির অধিকাংশই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল । ফলে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অথচ ব্যর্থ নীতি তাকে ক্রমশঃ সমালোচনার জালে আবদ্ধ করেছিল । যাই হোক , তার কার্য সমূহকে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃরাষ্ট্রীয় , —এই দু’ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে ।
দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধন । তিনি রাজ্যের আয় ব্যয়ের হিসেব সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করেন এবং দেশের সর্বত্র সমহারে রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন । রাজকোষে বাড়তি আয় সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি রাজস্বের হার বৃদ্ধি করতে মনস্থ করেন । এই সিদ্ধান্ত তিনি প্রথম প্রয়োগ করেন দিল্লীর সন্নিকটস্থ দোয়াব অঞ্চলে । সম্ভবত দোয়াবের চাষযোগ্য জমির উর্বরতার জন্যই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।
বরনীর মতে , মহম্মদ বিন তুঘলক রাজস্বের হার ৫-১০ গুন বৃদ্ধি করেছিলেন । চাষীদের উৎপাদনের অর্ধাংশ রাজস্ব দিতে হত । তার উপর এই বৃদ্ধি ঘটলে তারা চরম বিপদের সম্মুখীন হয় । আবার সেই সময় দোয়াবে দুর্ভিক্ষ চলছিল । অনাবৃষ্টির ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়েছিল প্রচণ্ডভাবে । এই অবস্থায় সুলতানের কর্মচারীরা জোরপূর্বক অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে শুরু করলে নানা স্থানে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় । অনেকে চাষ বন্ধ করে দিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেয় । এমনকি অতিরিক্ত রাজস্বের ভয়ে অন্যান্য অঞ্চলের চাষীরাও জঙ্গলে পালিয়ে যায় । একই সঙ্গে চলতে থাকে সুলতানি কর্মচারীদের নিপীড়ন ।
বরনীর মতে , হাজার হাজার মানুষ অনাহারে অথবা রাজকর্মচারীর অত্যাচারে মারা যায় । কিন্তু প্রজাদের দুর্দশা ও দুর্ভিক্ষের কথা জানতে পেরে মহম্মদ বিন তুঘলক অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় বন্ধ করে দেন এবং কৃষি উন্নতির জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি কৃষকদের কৃষিঋণ ( সোন্ধার ) দানের ব্যবস্থা করেন । পতিত জমিকে কৃষিযোগ্য করার জন্য আমীর ই কোহী নামক একটি স্বতন্ত্র দপ্তর গঠন করেন । এই কাজে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন ।
ব্যর্থতার কারণ :
কিন্তু তাঁর কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি । ড. ত্রিপাঠীর মতে , কৃষি ঋণদানের পদ্ধতি সম্পর্কে সুলতানি কর্মচারীদের কোন জ্ঞান ছিল না বলেই এই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল । বহু লোক ঋণ নিয়েও তা জমির উন্নয়নে লাগায়নি । তা ছাড়া , যে অঞ্চলে জমি উন্নয়নের জন্য টাকা দেওয়া হচ্ছিল সে অঞ্চলের জমিতে কোনভাবেই কৃষিকাজ করা যেত না । ফলে কৃষির উন্নতি হয়ইনি , পরন্তু কোষাগারের শূন্যতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
রাজধানী স্থানান্তর
মহম্মদ বিন তুঘলকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ছিল দিল্লী থেকে দেবগিরি বা দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিতকরণ । বরনী , ইসামী , ইবন বতুতা প্রমুখ এর জন্য সুলতানের ব্যক্তিগত কারণের উল্লেখ করেছেন । কিন্তু আধুনিক গবেষকরা সুলতানের এই পরিকল্পনার পিছনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পেয়েছেন । গার্ডনার ব্রাউন এর মতে , দেবগিরি ছিল দেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত । তাই মোঙ্গল আক্রমণ বা অন্যান্য দিক থেকে দিল্লীর তুলনায় ছিল নিরাপদ । তা ছাড়া দক্ষিণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ভাগে করাও ছিল সুলতানের উদ্দেশ্য ।
ড. হোসেন , হবিব উল্লাহর মতে , রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক প্রয়োজনে সুলতান এই পরিকল্পনা করেন । কারণ দক্ষিণে ছিল হিন্দু প্রাধান্য । ফলে ঐ অঞ্চলে ইসলামীয় সংস্কৃতি ও প্রভাব ছিল খুব ক্ষীণ । রাজধানী স্থাপন করে দক্ষিণ ভারতে মুসলিম প্রাধান্যকে স্থায়ী ও সুদৃঢ় করা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ।
ব্যর্থতার কারণ :
গুরুত্ব অপরিসীম হলেও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির অভাবহেতু তাঁর এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়েছিল । কারণ দুই অঞ্চলের দূরত্ব ছিল বিরাট । পথ ঘাট ছিল না বললেই চলে । সুলতান পথঘাটের উন্নয়নে অর্থব্যয় করলেও , প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল । ফলে যাত্রাপথেই বহু লোক , গবাদি পশু ইত্যাদি মারা যায় ।
দ্বিতীয়ত , দৌলতাবাদের জলবায়ু দিল্লীর অধিবাসীদের অসহ্য হয় । ফলে সুলতানের প্রতি সবাই অসন্তুষ্ট হয় । শেষ পর্যন্ত তিনি আবার দিল্লীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দেন ।
প্রতীক মুদ্রার প্রচলন
সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অপর উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা ছিল প্রতীক মুদ্রার প্রচলন । সেই সময়ে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা চালু ছিল । তবে রৌপ্য মুদ্রাই ছিল বেশি । কিন্তু বাংলাদেশে সুলতানি কর্তৃত্ব অস্বীকার করলে রূপার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে । কারণ বাংলাদেশই দিল্লীতে রূপার যোগান দিত । এই অবস্থার মোকাবিলা করতে মহম্মদ বিন তুঘলক প্রতীক তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন ।
ব্যর্থতার কারণ :
মহম্মদ বিন তুঘলকের প্রতীক মুদ্রা প্রবর্তনের প্রয়াস শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় । কারণ
( ক ) স্বল্প মূল্যের সহজলভ্য ধাতু দিয়ে মুদ্রা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ধরনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সাবধানতা প্রয়োজন , সুলতান তা নিতে পারেননি ।
( ২ ) প্রতীক মুদ্রার ধাতুমূল্য না থাকায় বিদেশী বণিকেরা ঐ মুদ্রা গ্রহণ করতে অরাজী হয় । ফলে বাণিজ্যে মন্দা আসে ।
( ৩ ) সারাদেশ জাল মুদ্রায় ভরে যায় । ফলে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক আকার নেয় ।
( ৪ ) এই মুদ্রা নতুন হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের কাছেও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি । শেষ পর্যন্ত সুলতান দেশের সমূহ তাম্র ও বোঞ্জ মুদ্রার বিনিময়ে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা প্রদানের ব্যবস্থা করেন ।
খোরাসান প্রকল্প
পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও মহম্মদ বিন তুঘলক এমন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন , যার ফল শুভ হয়নি । এই প্রসঙ্গে তার খোরাসান ও ইরাক জয়ের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । সম্ভবত কিছু খোরাসানী বিদ্রোহী আমীরের প্ররোচনায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন । বস্তুত এই পরিকল্পনার পিছনেও যুক্তিবোধের অভাব ছিল না । তখন মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অস্থির । তখন তৈমুরের জন্মও হয়নি । ফলে ঐ অঞ্চলে দিল্লীর আধিপত্য বিস্তার খুব কঠিন কাজ ছিল না ।
অধ্যাপক নিজামীর মতে , তাঁর এই ‘ উচ্চ সাম্রাজ্যবাদ ’ সফল হলে সুলতান বিশ্ব বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতেন । এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় চার লক্ষের এক বিরাট সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং এক বছর ধরে তাদের পোষণ করেন । ফলে রাজকোষের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে । কিন্তু শেষকালে দুর্গম পর্বতসঙ্কুল পথের মধ্য দিয়ে এত দূরে আক্রমণ করা সম্ভব নয় বিবেচনা করে এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন । এইভাবে তিনি হঠকারিতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ।
কারাজল অভিযান
অতঃপর তিনি পার্বত্য উপজাতিদের দমনের উদ্দেশ্যে নগরকোট ও কারাজলে ( কারাচিল ) অভিযান প্রেরণ করেন । এক্ষেত্রে তিনি প্রাথমিকভাবে সফল হন এবং পার্বত্য জাতিগুলি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে । অবশ্য তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি । মহম্মদ বিন তুঘলকের বিভিন্ন পরিকল্পনার উপর্যুপরি ব্যর্থতা ও শাসনযন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে দেশে একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ সংঘটিত হয় । তাদের মধ্যে কয়েকটি বিদ্রোহ দমনে তিনি সক্ষম হলেও বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন । ফলে তখন একাধিক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে।