আলাউদ্দিন খলজির নরপতিত্বের আদর্শ
আলাউদ্দিন খলজির নরপতিত্বের আদর্শ
নরপতিত্বের আদর্শ সম্পর্কে আলাউদ্দিনের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং নতুন । সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি বলবন কর্তৃক প্রবর্তিত নরপতিত্বের আদর্শের অনুকরণে এবং নিজ চিন্তা ভাবনার সংমিশ্রণে এক নতুন আদর্শ প্রচার করেন ।’ Kingship knows no kingship‘— এই মতবাদটিই ছিল আলাউদ্দিনের রাজ আদর্শের ভিত্তি । বলবনের মত তিনিও সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা , রাজার দৈব স্বত্ত্ব ( Divine origin ) এবং সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন । শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে কোন রাজার দৈবস্বত্ত্ব ব্যক্তি বা দলের প্রভাব তিনি বরদাস্ত করতেন না ।
ত্রয়োদশ শতকে দিল্লীর সুলতানগণ উলেমা ও অভিজাতদের বিশেষ প্রভাবাধীন ছিলেন । এদের ক্রিয়াকলাপ রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী হলেও সুলতানগণ এদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারতেন না । কিন্তু এই বিষয়ে আলাউদ্দিনের দৃষ্টি ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ ভঙ্গি ছিল খুবই স্পষ্ট । তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন , রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ অনুযায়ী চলবে , কোন বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ অনুযায়ী নয় । এজন্য প্রথমেই তিনি পুরাতন অভিজাত শ্রেণীকে নির্মূল করেন । পরিবর্তে যাদের তিনি দিল্লী দরবারে আনেন , তারা কেউই সুলতানের উপর প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করেনি । রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের তথা সুলতানের সাথে ধর্মীয় নেতাদের সম্পর্কের ব্যাপারেও আলাউদ্দিনের নীতি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ।
তুর্কী-আফগান শাসকদের রাজাদর্শের সাথে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের ( Theocratic state ) আদর্শের বহুল সাদৃশ্য ছিল । এই ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে উলেমাদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু আলাউদ্দিন রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামীয় ধর্মনীতি বা শরিয়তের বিধানের অবসান ঘটাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন । তিনি চেয়েছিলেন , ধর্ম ও রাষ্ট্রকে স্ব স্ব পথে চালিত করতে । তাঁর মতে , ধর্ম হল মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার । ধর্মগুরুদের কাজ হল ধর্ম সাহিত্য চর্চা করা এবং কোরানের বিধান অনুসারে কর্মাদর্শের দ্বারা মানুষকে ধর্মপথে আকৃষ্ট করা । এর বাইরে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ধর্মীয় হস্তক্ষেপ তিনি সহ্য করতেন ।
কারও কারও মতে , আলাউদ্দিন ইসলামের অনুশাসন মানতেন না । এক কথায় , তিনি ছিলেন ধর্মদ্রোহী । কিন্তু এই অভিমত সঠিক নয় । কারণ তিনি ধর্মবিরোধী কোন কাজ করেন নি। এমনকি বহির্ভারতে তিনি ‘ ইসলামের ধর্ম রক্ষক ’ রূপে পরিচিত ছিলেন । ড. ত্রিপাঠীর মতে , সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ধর্মীয় নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করা ছিল আলাউদ্দিনের বড় কৃতিত্ব । আসলে আলাউদ্দিনের নরপতিত্বের আদর্শ ছিল প্রয়োজন প্রসূত । তাঁর গৃহীত নীতির মূলে ছিল অবাধ স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে জনগণের কণ্ঠরোধ কার ।
ফরাসীরাজ চতুর্দশ লুই এর মত তিনিও ‘ আমিই রাষ্ট্র ‘ এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন । আলাউদ্দিনের নরপতিত্বের আদর্শ ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করেছিল ঠিকই , তবে এটি ছিল অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট । কারণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করার ব্যাপারে তিনি অনেক সময় উলেমাদের পরামর্শ ও সক্রিয় সহায়তা গ্রহণ করেছেন । হয়তো নিজের ক্ষমতাকে সর্বাত্মক করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি কতকগুলি ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শমূলক রীতিনীতি গ্রহণ করেছিলেন মাত্র ।