খলজি বিপ্লব কি
Contents
খলজি বিপ্লব কি
১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে মামেলুক তুর্কী সুলতান কাইকোবাদ’কে হত্যা করে মামেলুক শাসনের অবসান ঘটান হয় এবং দিল্লীতে খলজী বংশের শাসন কায়েম হয় । এই ঘটনা সমকালীন রাজনীতির ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছিল বলে কেউ কেউ একে ‘ খলজী বিপ্লব ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন ।
খলজি বিপ্লবের কারণ
জাতি বৈষম্য জনিত বিরোধ :
মামেলুক তুর্কীরা প্রায় ৮০ বছর দিল্লীর সুলতানি শাসন পরিচালনা করেছিলেন । এঁদের শাসনতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তুর্কীদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা । কিন্তু ইতিমধ্যে বহু অ-তুর্কী মুসলমান ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছে । ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলমানের সংখ্যাও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে । এই সকল বহিরাগত অ-তুর্কী ও ভারতীয় ( হিন্দুস্থানী ) মুসলমানেরা তুর্কী একাধিপত্যে বেশ অসন্তুষ্ট ছিল । এই সকল বহিরাগত অ-তুর্কী মুসলমানদের মধ্যে খলজীরাও ছিল ।
খলজীরা ছিল নানা বিষয়ে দক্ষ , যোগ্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী । কিন্তু জাতিগত কারণে রাজনৈতিক কাজে তারা ছিল অবহেলিত ও বঞ্চিত । এইসব উচ্চাকাঙ্ক্ষী গোষ্ঠী দিল্লীর ক্ষমতা দখলের জন্য উন্মুখ ছিল । বলবনের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্বল ও অযোগ্য বংশধরদের আমলে খলজীরা তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছাপূরণের সুযোগ পায় ।
রাজনৈতিক অস্থিরতা :
তখন দিল্লীর মসনদে ছিলেন বলবনের পৌত্র কায়কোবাদ ( ১২৮৭ – ‘৯০ খ্রীঃ ) । মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি মসনদে আরোহণ করেন । তিনি ছিলেন দায়িত্ব বোধহীন , আরাম প্রিয় ও চরিত্রহীন ব্যক্তি । সিংহাসনে বসেই তিনি ব্যভিচারে গা ভাসিয়ে দেন , রাজকাজ হয় অবহেলিত । নিজামউদ্দিন নামক একজন অভিজাত এই সুযোগে সম্পূর্ণ রাজক্ষমতা হস্তগত করে নেন । পুরানো অভিজাতরা হন লাঞ্ছনার শিকার । দেশজুড়ে শুরু হয় অরাজকতা । এমতাবস্থায় কায়কোবাদ নিজামউদ্দিনকে হত্যার নির্দেশ দেন ।
অতঃপর মালিক ফিরোজ প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত হন । এই নিয়োগে তুর্কী অভিজাতরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন । তারা আশঙ্কা করেন যে , ফিরোজ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তুর্কীদের অপসারিত করে সম্পূর্ণ রাজক্ষমতা কুক্ষীগত করবেন । এর প্রতিরোধকল্পে তারা কাইকোবাদের জীবিতাবস্থায় তাঁর শিশুপুত্র কাইমর্সকে দিল্লীর সুলতান বলে ঘোষণা করেন ( ১২৮৯ খ্রীঃ ) । অতঃপর তারা ফিরোজকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু করেন ।
খলজি বিপ্লব
তুর্কীদের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে ফিরোজ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে দিল্লীর অদূরে বাহারপুরে আশ্রয় নেন । খলজীগণ দিল্লী আক্রমণ করে কাইমর্সকে বন্দী করে বাহারপুরে গৃহবন্দী করেন । তুর্কী নেতা কাচ্চন , সুরখা প্রমুখ খলজীদের হাতে নিহত হলে তুকী গোষ্ঠী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে । অতঃপর ফিরোজ এর নির্দেশে অসুস্থ কাইকোবাদকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ যমুনার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল । অতঃপর মালিক ফিরোজ ‘ জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহ ’ নাম ধারণ করে নিজেকে দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত করেন ( ১২৯০ খ্রীঃ ) , এই ঘটনাই ইতিহাসে ‘ খলজি বিপ্লব ’ নামে খ্যাত ।
খলজি বিপ্লবের গুরুত্ব
ইলবেরী তুর্কীদের পরিবর্তে দিল্লীতে খলজী বংশের উত্থান নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত । এই খলজী বিপ্লব দ্বারা দিল্লীর শাসন ইতিহাসে কেবল রাজবংশের পরিবর্তন ঘটেছিল , তাই নয় ; এই ঘটনার দ্বারা ভারতে মুসলমান কর্তৃত্বের সম্প্রসারণ , শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতি সাধন প্রভৃতিরও সূচনা হয়েছিল । খলজী বিপ্লবের সাফল্য ও রাজ কর্তৃত্বের পরিবর্তন দ্বারা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে , সিংহাসনে কোন বিশেষ শ্রেণী বা জাতির অধিকার একচেটিয়া নয় । তাই খলজী বিপ্লবকে জাতিগত একাধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতীয় ও অ-তুর্কী মুসলমানদের একটি সফল গণ অভ্যুত্থান বলে বর্ণনা করা যায় ।
দ্বিতীয়ত , খলজী বিপ্লবের সাফল্য প্রমাণ করেছে যে , ক্ষমতা লাভের প্রধান উৎস হল সংখ্যা গরিষ্ঠ অভিজাত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সমর্থন । জাতি বা শ্রেণীগত ঐতিহ্য সেক্ষেত্রে মূল্যহীন ।
তৃতীয়ত , খলজী বিপ্লবের দ্বারা দিল্লীর প্রশাসনে পুনরায় সামরিক শক্তির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । তুর্কীদের দীর্ঘ শাসন সামরিক শক্তির পরিবর্তে প্রশাসনে সামাজিক কর্তৃত্বের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল , এই ঘটনার ফলে তা ব্যাহত হয় ।
চতুর্থত , খলজী বিপ্লবের পরেই অনুভূত হয়েছিল যে , দিল্লীর নতুন মুসলমান শাসনকে কেন্দ্র করে একটা গণ আনুগত্য সৃষ্টি হয়েছে । তাই দেখা যায় যে , ক্ষমতা দখল করার পরেও ফিরোজ খলজী প্রায় এক বছর দিল্লীতে ঢুকতে পারেননি । সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘ ৮০ বছরে তুর্কীদের শাসনের প্রতি একধরনের আনুগত্য গড়ে উঠেছিল । তাই ফিরোজ কর্তৃত্ব এই ধরনের নৃশংসতা ও ক্ষমতা দখল সাধারণ মানুষ অনধিকার বলেই মনে করে । কিন্তু ফিরোজ তাঁর উদারতা , ন্যায় পরায়ণতা , মহানুভবতা প্রভৃতি সৎ গুণের দ্বারা মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন ।