ইতিহাস

ভক্তিবাদী আন্দোলনে শ্রীচৈতন্যদেবের অবদান

ভক্তিবাদী আন্দোলনে শ্রীচৈতন্যদেবের অবদান

বাংলাদেশে ভক্তিবাদের আদর্শে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন চৈতন্যদেব । তিনি নদিয়া জেলায় এক শিক্ষিত পরিবারে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাল্যনাম ছিল নিমাই । চব্বিশ বছর বয়সে তিনি গৃহ ত্যাগ করে বৈষ্ণব গুরু ঈশ্বর পুরীর কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র ও দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন । 

শ্রীচৈতন্যদেব এর মতাদর্শ

শ্রীচৈতন্যদেবের মতে , জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষই আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হতে পারে । বৈরাগ্য ও কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি জীবের মুক্তি আনবে , —তিনি এই তত্ত্ব প্রচার করেন । চৈতন্য প্রচারিত ধর্মের তিনটি মূলকথা ছিল , — জীবে দয়া , ঈশ্বরে ঐকান্তিক ভক্তি এবং নাম সংকীর্তন । শ্রীচৈতন্য জাতিভেদ , অস্পৃশ্যতা ও বর্ণভেদ মানতেন না , তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন যবন হরিদাস নামে এক মুসলমান । জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের সমানাধিকারের বাণী তিনি প্রচার করেন । চৈতন্য প্রচারিত ধর্মমত ‘ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ’ ধর্ম নামে পরিচিত ।

প্রভাব 

ভারতে ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য ছিলেন এক মহাবিপ্লবী । তাঁর মতবাদ ‘ চন্ডালোহপি দ্বিজ শ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ ‘ ( হরিভক্ত চণ্ডাল ব্রাক্ষ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ) বাংলা তথা ভারতের ধর্মক্ষেত্রে এক মহাপ্লাবন এনেছিল । বর্ণভেদ ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সাম্যের বাণী প্রচার করে তিনি সমাজের শোষিত ও অবহেলিত মানুষদের এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন এবং অন্যদিকে রক্ষণশীল সমাজে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলেন । 

এই কারণে নিম্নবর্ণের অগণিত মানুষ তাঁর বর্ণহীন গোষ্ঠীতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যোগ দিয়ে বর্ণের কলঙ্ক মুছে ফেলতে সচেষ্ট হয়েছিল । এর ফলে হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল । চৈতন্যদেবের জীবনী ও ধর্মমতকে ভিত্তি করে বহু বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয় । যেমন— ‘ চৈতন্য ভাগবত ’ , ‘ চৈতন্যমঙ্গল , ‘ চৈতন্য চরিতামৃত ‘ ইত্যাদি । এ ছাড়া বহু কীর্তন রচিত হয় । এর ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয় । তাঁর অনুগামীরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব নামে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করেন । 

আচার্য সুকুমার সেন শ্রীচৈতন্য প্রচারিত ভক্তিবাদের গভীরতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন , “ তাঁর ( চৈতন্যদেব ) প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হইয়া বাঙ্গালীর প্রতিভা কি ধর্মে , কি দার্শনিক চিন্তায় , কি সাহিত্যে , কি সঙ্গীত কলায় সর্বত্র বিচিত্রভাবে স্ফূর্ত হইতে থাকে । এটাই বাঙ্গালী জাতির প্রথম জাগরণ ” ।

error: Content is protected !!