ইতিহাস

সুলতানা রাজিয়ার কৃতিত্ব

সুলতানা রাজিয়ার কৃতিত্ব 

ইলতুৎমিসের জীবিতকালেই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দিন মারা যান । তাঁর অপর পুত্র রুকনউদ্দিন ছিলেন দুর্বলচেতা , অযোগ্য এবং অন্যান্য পুত্ররা ছিল নাবালক । এই অবস্থায় তিনি কন্যা রিজিয়াকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করা স্থির করেন । কারণ রিজিয়া ছিলেন যথেষ্ট সাহসী , দক্ষ এবং বুদ্ধিমতী । ইলতুৎমিস রিজিয়ার মনোনয়নকে সুনিশ্চিত করার জন্য নিজ মুদ্রার সাথে রিজিয়ার নামাঙ্কিত মুদ্রার প্রচলন করেন ।  

কিন্তু পরবর্তী সুলতান হিসেবে রিজিয়ার মনোনয়নে আমীর-ওমরাহ বা উলেমাদের আন্তরিক সমর্থন ছিল না । তাই ইলতুৎমিসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তারা রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন । সম্ভবত একজন মহিলাকে শাসক হিসেবে বরণ করতে ওমরাহদের পৌরুষে বাধছিল । যাই হোক , রিজিয়া পরিস্থিতিকে সহজ মনেই মেনে নিয়েছিলেন ।  

কিন্তু রুকনউদ্দিন ছিলেন অযোগ্য , ভীরু ও দুশ্চরিত্র । এই অবস্থায় তাঁর মা শাহ তুর্কানের হাতেই সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল । তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষিণী । কতিপয় অনুগামীর সাহায্যে তিনি শুরু করেন শোষণ ও অত্যাচার । সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা । এরূপ কুশাসনে বিরক্ত হয়ে তুর্কী আমিররা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । মুলতান , বদাউন , হান্সি ও লাহোরের প্রাদেশিক শাসন কর্তারা দিল্লী আক্রমণে অগ্রসর হলে রুকনউদ্দিন তাদের বাধা দিতে সসৈন্যে অগ্রসর হন । কিন্তু তিনি পরাজিত ও নিহত হন । এই সুযোগে দিল্লীর কিছু আমীর ও নাগরিকদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ও সক্রিয় সহযোগিতায় রিজিয়া দিল্লীর মসনদ দখল করেন ( ১২৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ) ।  

সুলতান রিজিয়ার সিংহাসনারোহণ এর কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা যায় , যথা- 

( ১ ) জনসাধারণের সক্রিয় সহায়তায় রিজিয়া সিংহাসনে বসেছিলেন । দিল্লীর ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম শাসক মনোনয়নে জনগণ ভূমিকা পালন করে । 

( ২ ) রিজিয়াই প্রথম প্রশাসক , যিনি জনগণের সাথে একটি অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন — যার অন্যতম শর্ত ছিল রিজিয়াকে জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে । 

( ৩ ) আমীর-ওমরাহদের বিরোধিতা সত্ত্বেও ইলতুৎমিস ঘোষিত উত্তরাধিকার বাস্তবায়িত হয়েছিল । 

( ৪ ) রিজিয়ার সিংহাসনে আরোহণ প্রমাণ করেছিল সুলতান নির্বাচনে আমীর-ওমরাহ বা প্রাদেশিক শাসন কর্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা শেষ কথা নয় । 

( ৫ ) মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসে রিজিয়াই ছিলেন প্রথম নারী শাসিকা । সিংহাসনে বসেও রিজিয়া নিষ্কণ্টক ভাবে রাজ্য শাসন করতে পারেননি । হান্সি , বদাউন , লাহোর , মুলতানের বিদ্রোহী শাসকগণ রিজিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে দিল্লী অবরোধ করেন । অবশ্য কূটচালে বিদ্রোহীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রিজিয়া এই সংকট থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন । এরপর পূর্বে বাংলাদেশ হতে পশ্চিমে সিন্ধুর দেবল পর্যন্ত সকল মালিক ও আমীর রিজিয়ার বশ্যতা স্বীকার করে ।  কিন্তু এ-ও দীর্ঘস্থায়ী হল না । 

তাঁর শাসন সংগঠন নীতি তুর্কী মালিকদের স্বার্থে আঘাত করলে পুনরায় বিদ্রোহের সূচনা হয় ।  

প্রথমত , রিজিয়া সুলতানের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে আমীরদের নিষ্ক্রিয় করতে উদ্যোগী হন । এতে তারা রুষ্ট হয় ।  

দ্বিতীয়ত , তিনি উচ্চ রাজপদে তুর্কী আমীরদের একক আধিপত্য নষ্ট করে দেন । জনৈক হাবসী অনুচর ইয়াকুতকে তিনি উচ্চ রাজপদ ও ক্ষমতা দেন । কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে , ইয়াকুতের সাথে রিজিয়ার প্রণয় ছিল । এই ঘটনা তুর্কীদের মর্যাদায় আঘাত করে ।  

তৃতীয়ত , রিজিয়া পুরুষের পোশাক পরে প্রকাশ্য রাজদরবারে বসতেন এবং ঘোড়ায় চড়ে রাজ্য পরিভ্রমণ করতেন । এতে গোড়া মুসলিমরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল ।  

উপরোক্ত কারণে রিজিয়ার বিরুদ্ধে পুনরায় এক ষড়যন্ত্র রচিত হয় । পাঞ্জাবের শাসনকর্তা কবীর খাঁ সর্বপ্রথম রিজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । রিজিয়া খুব সহজেই এই বিদ্রোহ রিজিয়ার পতন দমন করেন ( ১২৪০ খ্রীঃ ) । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাতিণ্ডার শাসনকর্তা আলতুনিয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । দিল্লীর আমীর আইতেগিন ছিলেন এই বিদ্রোহের পরামর্শদাতা । যাই হোক , রিজিয়া আলতুনিয়াকে দমন করতে সসৈন্যে ভাতিণ্ডা গমন করেন , কিন্তু ভাতিণ্ডা দুর্গ আক্রমণকালে রিজিয়া পরাজিত ও বন্দী হন । ইয়াকুৎকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । দিল্লীর আমীররা রিজিয়ার ভাই মুইজউদ্দিন বাহরম শাহকে দিল্লীর সিংহাসনে বসায় ( ১২৪০ খ্রীঃ)।  

কিন্তু অপরাপর আমীরদের কাছে উপযুক্ত মর্যাদা না পাওয়ায় আলতুনিয়া রিজিয়াকে মুক্ত করে দেয় এবং তাকে বিবাহ করে । আলতুনিয়ার উদ্দেশ্য ছিল রিজিয়াকে দিল্লীর সিংহাসনে বসিয়ে নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আমীরদের শাস্তি দেওয়া । এই উদ্দেশ্যে উভয়ে দিল্লী অভিমুখে সসৈন্য রওনা হন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রিজিয়া বাহরাম শাহের হাতে পরাজিত হন । অতঃপর আলতুনিয়া ও রিজিয়াকে হত্যা করা হয় ( ১২৪০ খ্রীঃ ) । নারী হলেও রিজিয়া ছিলেন যোগ্য প্রশাসিকা । মিনহাজ উদ্দিনের মতে , “ সুলতান পদ অধিকার করার মত সমস্ত গুণ তার ( রিজিয়ার ) ছিল । ”  

কৃতিত্ব বিচার

শত বিপদেও তিনি ধৈর্য হারাতেন না বা নিজ লক্ষ্যপথ থেকে সরে আসতেন না । মাত্র সাড়ে তিন বৎসরকাল রাজত্বে তিনি সুলতানি ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে সমর্থ হয়েছিলেন । উচ্চপদে অ-তুর্কীদের মনোনীত করে তিনি য্যেগ্যতার মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হননি । পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শান্তিনীতির অনুগামী । তাই মোঙ্গল-খারজিম সংগ্রামে তিনি নিরপেক্ষ থেকে দিল্লীর শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন । বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছাড়াও তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী , ন্যায়পরায়ণ প্রজানুরাগী । এত গুণ থাকা সত্ত্বেও কেবল নারী বলে পুরুষের বিচারে তাঁর গুণাবলী কোন মর্যাদা পেল না ।

error: Content is protected !!