বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
Contents
বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তীকালে তুর্কী অভিজাতদের স্বাধীনতা স্পৃহা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দিল্লীর সুলতানি রাজ্য নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে পড়েছিল । তখন প্রয়োজন ছিল একজন কঠোর , শক্তিশালী , দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও ব্যক্তিত্ববান শাসকের । এরূপ পরিস্থিতিতে সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের সিংহাসনারোহণ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । কৃতিত্বের দিক হতে বিচার করলে তাকে দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বলা যেতে পারে । প্রায় চল্লিশ বৎসরকাল সিংহাসনে থেকে তিনি তুর্কী সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে গিয়াসুদ্দিনই সর্বপ্রথম রাজতন্ত্রের আদর্শের ব্যাপক ব্যাখ্যা করেন । তিনি চেয়েছিলেন রাজতন্ত্রকে একটি মহতী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে । বলবনের রাজতন্ত্রের আদর্শের মূল ভিত্তি ছিল পারসিক রাজতন্ত্রের আদর্শ ।
রাজার দৈব স্বত্ব
বলবন মনে করতেন , রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি ( লিবারৎ-ই-খুদা ) । তাঁর মতে , সুলতানের ক্ষমতার উৎস ছিলেন ঈশ্বর । তুর্কী অভিজাত বা জনসাধারণের সম্মতির উপর রাজতন্ত্র নির্ভরশীল নয় ।
বাহ্যিক আড়ম্বর
বলবন সুলতানের বাহ্যিক আড়ম্বর ও মর্যাদার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন । তিনি সর্বদাই জনগণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতেন । সাধারণ মানুষের সাথে বাহ্যিক আড়ম্বর সুলতানের বাক্যালাপকে তিনি মর্যাদা হানিকর মনে করতেন । এমনকি , দরবারে একমাত্র উজীর বা প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারত না । তিনি মানুষের বংশগত ব্যাপারে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ মেনে চলতেন । রাজার দৈহিক পবিত্রতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল । উপযুক্ত রাজপোশাক পরিধান না করে ও আনুষঙ্গিক রাজকীয় জিনিসপত্র ব্যতিরেকে এবং উন্মুক্ত দরবারের মর্যাদা তরবারিহস্তে সুসজ্জিত দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবৃত না হয়ে তিনি কখনও জনসমক্ষে বা দরবারে বেরোতেন না ।
দরবারের মর্যাদা
তাঁর মতে , স্বেচ্ছাচারী রাজক্ষমতাই রাজ্যের সংহতির একমাত্র উৎস । এই কারণে বলবন তাঁর দরবারে কয়েকটি অবশ্য পালনীয় পারসিক আদাব কায়দার প্রবর্তন করেন । এগুলি হল , ‘ সিজদা ‘ পারসিক আদব কায়দা অর্থাৎ সিংহাসনের সামনে নতজানু হওয়া , ‘ পাইবস ’ অর্থাৎ সিংহাসনের পদ চুম্বন করা ইত্যাদি । এগুলি ইসলামিক রীতি বিরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি জোরপূর্বক মেনে চলতে সবাইকে বাধ্য করতেন । তিনি রাজসভায় মদ্যপান ও নৃত্য-গীত নিষিদ্ধ করেন । এমনকি রাজদরবারে সুউচ্চ হাস্যরোল বা লঘু চপলতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল । তিনি বিভিন্ন স্তরের রাজকর্মচারীর জন্য পোশাক নির্দিষ্ট করে দেন ।
ন্যায় বিচার
প্রজাবর্গের প্রতি ন্যায় বিচার রাজার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে বলবন মনে করতেন । সাধারণ মানুষের প্রতি যে কোন ধরনের অন্যায় অবিচার বলবনের ক্রোধের সঞ্চার করত । ব্যক্তিগত ক্রীতদাসদের প্রতি দুর্ব্যবহার করার কারণে বলবন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের কঠোর শাস্তি দিতে দ্বিধা করতেন না ।
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে , কয়েকটি বিশেষ কারণে বলবন এরূপ রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেছিলেন ; যেমন — ক্ষমতালোভী অভিজাতগণের মধ্যে রাজক্ষমতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল , এবং যা ছিল সংহতির পরিপন্থী । এহেন অবস্থায় বলবন রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিভূ বলে প্রচার করে তুর্কী অভিজাতদের দাবিকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিলেন । সেই সঙ্গে ধর্মের দোহাই দিয়ে তিনি নিজের সীমাহীন স্বৈরাচারকে পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন ।
তা ছাড়া কিছু কিছু ব্যক্তিগত দুর্বলতা চাপা দেওয়াও বলবনের প্রচারিত রাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল । যেমন তিনি রাজবংশ জাত ছিলেন না । তিনি বাল্যজীবনে ক্রীতদাস ছিলেন । তাই সিংহাসনারোহণের কোন আইনগত অধিকার তাঁর ছিল না । সেই কারণে তিনি রাজার দৈবসত্ত্বের কথা প্রচার করে নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন ।