সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর মধ্যে পার্থক্য
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর মধ্যে পার্থক্য
সুলতান মাহমুদ ও মহম্মদ ঘুরী — এই দুই তুর্কী মুসলমান একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেছেন । তবে এঁদের ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য ও সাফল্যের বিচারে সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যই ছিল বেশি । তা ছাড়া মাহমুদ ও ঘুরীর ভারত আক্রমণের মধ্যে প্রায় ১৭৫ বছরের ব্যবধান ছিল । স্বভাবতই দু’জনের আক্রমণকালে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির বিস্তর ফারাক ছিল । যাই হোক , পণ্ডিতেরা এদের আক্রমণের তুলনামূলক বিচার করে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন ।
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর সাদৃশ্য
মাহমুদ ও ঘুরী কেউই নিছক ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত আক্রমণ করেন নি । তা ছাড়া , দু’জনেই ছিলেন তুর্কী মুসলমান এবং পাঞ্জাবকে কেন্দ্র করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন । এঁরা দুজনেই নিজ নিজ সেনাবাহিনীতে দক্ষ ভারতীয় সৈনিকদের নিযুক্ত করেছিলেন । এমনকি দুজনেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে জয়লাভের পর অর্থের বিনিময়ে এবং অধীনতার শর্তে ভারতীয় রাজাদের স্ব স্ব রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ।
সুলতান মাহমুদ ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযান এর বৈসাদৃশ্য
উপরোক্ত সাদৃশ্যের তুলনায় এঁদের আক্রমণে বৈসাদৃশ্য ছিল অনেক বেশি।
প্রথমত , সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের মূল প্রেরণা ছিল এদেশের অতুল ধনসম্পদ লুণ্ঠনের বাসনা । ভারতে সঞ্চিত ধনরত্নের প্রাচুর্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই তিনি অভিযানে লিপ্ত হন । সব অভিযানেই তিনি সফল হন । দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন ভারতবর্ষে তার পক্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের সম্পূর্ণ অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল । কিন্তু মাহমুদ এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোন উদ্যোগ নেননি ।
পক্ষান্তরে , মহম্মদ ঘুরী এদেশের সম্পদে প্রলুব্ধ হলেও , এটিই তার একমাত্র বাসনা ছিল না । একাধিকবার পরাজিত হলেও তিনি নতুন উদ্যমে আবার ভারত আক্রমণ করেছেন এবং এদেশে নিজ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন ।
মাহমুদের কোন গঠনমূলক পরিকল্পনা ছিল না , কিন্তু ঘুরীর ছিল । তাই মাহমুদ ভারত ইতিহাসে নিছক লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন , কিন্তু মহম্মদ ঘুরী পেয়েছেন সাম্রাজ্য সংগঠকের কৃতিত্ব ।
দ্বিতীয়ত , সুলতান মাহমুদ ছিলেন অনন্য সামরিক প্রতিভার অধিকারী । তিনি বহুবার ভারত আক্রমণ করে প্রতিবারই সাফল্য লাভ করেন । তুলনামূলকভাবে মহম্মদ ঘুরী ছিলেন অনেক নিষ্প্রভ । তিনি কম বার আক্রমণ করেও অন্তত তিনটি যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন ।
তৃতীয়ত , সুলতান মাহমুদের সামরিক প্রতিভা থাকলেও প্রশাসনিক প্রতিভা ছিল খুবই কম । তাই মধ্য এশিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও , তার স্থায়িত্ব ছিল না ।
অন্যদিকে ঘুরী ব্যক্তিগত সাংগঠনিক প্রতিভা ও প্রশাসনিক উদ্ভাবনী শক্তির দ্বারা আপন বিজয় ও সাম্রাজ্যকে স্থায়িত্ব দিতে পেরেছিলেন ।
চতুর্থত , ভারতে একজন নিষ্ঠুর সেনাপতি ও লুণ্ঠনকারী রূপে প্রতিভাত হলেও সুলতান মাহমুদ বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন । তিনি বিদ্বান ব্যক্তিদের সমাদর করতেন । উদবী , ফারবী , উজাবী , ফারুকী , ফিরদৌসী প্রমুখ সেকালের বহু জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন । তিনি গজনীকে একটি সমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত নগরীতে পরিণত করেন । তার চেষ্টায় গজনী ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয় ।
কিন্তু মহম্মদ ঘুরীর চরিত্রে সংস্কৃতি প্রীতির এই প্রাবল্য ছিল না । রাজ্য জয় ছাড়া কোন কিছুই তার চেতনায় ছিল না ।