সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণ

সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণ

ভারতে মুসলমান আধিপত্য বিস্তারে সুলতান মাহমুদের বিশেষ ভূমিকা ছিল । মাহমুদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন সামানিদ বংশীয় শাসকদের ক্রীতদাস ও কর্মচারী । ট্রান্স অক্সিয়ানা ,খোরাসান ও পারস্যের খানিকটা অঞ্চলে সামানিদ বংশের শাসন প্রচলিত ছিল । তুর্কী ক্রীতদাস আলপ্তগীন সামানিদ বংশের দুর্বলতার সুযোগে আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনীতে স্বাধীন তুর্কী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন ( ৯৬২ খ্রীঃ ) । গজনীর পরবর্তী শাসক সুবক্তগীন একাধিক বার ভারত আক্রমণ করেন , কিন্তু ব্যর্থ হন । পরবর্তী শাসক মাহমুদ পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন ।  

পিতা সুবক্তগীনের মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হত্যা করে মাহমুদ গজনীর সিংহাসন দখল করেন ( ৯৯৮ খ্রীঃ ) । সিংহাসন লাভের অল্পকালের মধ্যে তিনি নিজ দক্ষতার পরিচয় দেন । তার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে খলিফা মাহমুদকে ‘ আমিনুলমিলাত ’ ও ‘ ইয়ামিন উল্লাহ ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন । এইজন্য তার বংশ ‘ ইয়ামিন ’ বংশ নামেও পরিচিতি লাভ করে ।  

মাহমুদ ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা ও উচ্চাভিলাষী । সামরিক দক্ষতা ও ধর্মান্ধতা তাঁকে করে তুলেছিল দুর্ধর্ষ । সীমান্তদেশ ভারতের অতুল ধন-সম্পদ লাভের ইচ্ছা এবং বিধর্মী হিন্দুদের ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি বারবার ঝাপিয়ে পড়েছেন ভারতের উপর । 

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান 

সুলতান মাহমুদ কতবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে । তবে অধিকাংশের মতে , ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি মোট সতেরো বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন । ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে মাহমুদ প্রথম ভারত আক্রমণ করেন । তবে ঐ বছর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী কয়েকটি দুর্গ দখল করে তিনি ফিরে যান । কিন্তু পরের বছর শাহীরাজ্য আক্রমণ করে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন । জয়পাল প্রচুর অর্থ ও রাজ্যের কিয়দংশ দান করে মাহমুদের নিকট বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান । কিন্তু পরাজয়ের এই গ্লানি সহ্য করতে না পেরে পুত্র আনন্দ পালের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি আত্মহত্যা করেন । 

মাহমুদের তৃতীয় আক্রমণ ঘটে ১০০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে । প্রথমে তিনি ঝিলাম নদীর তিরস্ত ভীর রাজ্য দখল করেন । তারপর মুলতান আক্রমণ করেন । মুলতানের শাসক দাউদ বাৎসরিক কর প্রদানের শর্তে মাহমুদের সাথে সন্ধি স্বাক্ষর করেন ।  

মাহমুদের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য আক্রমণ ঘটে আনন্দ পালের বিরুদ্ধে ( ১০০৮-১০০৯ খ্রীঃ ) । মাহমুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে আনন্দ পাল উত্তর ভারতের হিন্দু রাজাদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান । কনৌজ , দিল্লী , আজমীর , গোয়ালিয়র প্রভৃতি রাজ্য কাংড়াদুর্গ লুণ্ঠন আনন্দপালের সাহায্যে এগিয়ে এলেও , শেষ পর্যন্ত মাহমুদ জয়লাভ করেন । ফলে সিন্ধুনদ থেকে নগরকোট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল মাহমুদের হস্তগত হয় । এই সময় কাংড়া দুর্গ লুণ্ঠন করে মাহমুদ প্রচুর ধনরত্ন স্বদেশে নিয়ে যান ।  

১০১৪ খ্রীষ্টাব্দে মাহমুদ থানেশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং জয়লাভ করে থানেশ্বর লুণ্ঠন করে এখান থেকেও প্রচুর ধনরত্ন লুণ্ঠন করে গজনীতে নিয়ে যান । আনন্দ পালের পুত্র ত্রিলোচন পাল মুসলিম ভীতি ত্যাগ করে হিন্দুদের শক্তি বিস্তারে অগ্রসর হলে মাহমুদ ১০১৩ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায় শাহীরাজ্য আক্রমণ করেন । তবে মাহমুদ জয়লাভ করলেও তাঁর প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিলোচন নিজ কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । ১০১৯ খ্রীষ্টাব্দে মাহমুদ আবার আক্রমণ ঘটিয়েও পাঞ্জাবকে পদানত করতে ব্যর্থ হন । অবশেষে ত্রিলোচন পালের মৃত্যুর পর মাহমুদ পাঞ্জাব অধিকার করতে সমর্থ হন ( ১০২১ খ্রীঃ ) ।

অতঃপর মাহমুদ গঙ্গা-যমুনার উপত্যকা অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনে অগ্রসর হন । প্রথমে তিনি মথুরা ও পরে কনৌজ আক্রমণ করেন । এই দুই স্থানেই প্রায় বিনা বাধায় তিনি অপরিমিত ধনৈশ্বর্য লুণ্ঠন করেন ( ১০১৮ খ্রীঃ ) । পরের বছর সুলতান মাহমুদ চান্দেলরাজ গণ্ডকে পরাজিত করে প্রভূত পরিমাণ ধনরত্ন লাভ করেন ।  

সুলতান মাহমুদের ভারতীয় অভিযান সমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল কাথিয়াবাড়ে অবস্থিত সোমনাথ মন্দির আক্রমণ লুণ্ঠন । এই মন্দির বিধ্বস্ত ও লুণ্ঠন করে তিনি প্রায় দু’কোটি স্বর্ণমুদ্রা ও প্রভূত স্বর্ণালংকার দখল করেছিলেন । মাহমুদের সর্বশেষ অভিযান ছিল জাঠদের বিরুদ্ধে ( ১০২৭ খ্রীঃ ) । অবশেষে ১০৩০ খ্রীষ্টাব্দে মাহমুদ গজনীতে মারা যান ।  

সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের ফলাফল

সুলতান মাহমুদ বারবার ভারত আক্রমণ করলেও , ভারত ইতিহাসে এই আক্রমণের কোন স্থায়ী প্রভাব ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না । একমাত্র মুলতান ও পাঞ্জাব ছাড়া অন্য কোন ভারতীয় অঞ্চল তিনি গজনীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি ।  

ইরফান হাবিবের মতে , দুর্ধর্ষ রাজপুত জাতিকে পদানত করা অসম্ভব বিবেচনা করেই মাহমুদ স্থায়ী রাজ্য গঠনে উদ্যোগী হননি । তা ছাড়া , মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য তিনি এত বেশি বিচলিত ছিলেন যে , ভারতে স্থায়ী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার উৎসাহ পাননি । 

কেউ কেউ মনে করেন , ইসলাম ধর্ম প্রচার করাই ছিল মাহমুদের ভারত অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য । একথা সত্য , কোন কোন বিজিত অঞ্চলে অন্য ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল । কিন্তু তার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য । এমনকি ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির উপরেও ইসলামের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি ।  

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে , ভারতের অতুল ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল মাহমুদের ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য । ভি. স্মিথ  মাহমুদকে ‘ লুণ্ঠনকারী দস্যু’বলে বর্ণনা করেছেন । 

সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের প্রত্যক্ষ ফল গুরুত্বহীন হলেও , কিছু পরোক্ষ প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য ।  

প্রথমত , মাহমুদ বারবার ভারত আক্রমণ করে এদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাকে চুরমার করে দিয়েছিলেন । ফলে পরবর্তীকালে ঐ পথ ধরেই বিদেশী আক্রমণকারীরা ভারতে ঢুকতে পেরেছে ।  

দ্বিতীয়ত , মাহমুদ ভারতবর্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করার ফলে ভারতের আর্থিক ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে ।  

তৃতীয়ত , মাহমুদের আক্রমণের ফলে ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা ও সামরিক ত্রুটি বিদেশীদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল । একদিকে ভারতের সম্পদের লোভ অন্যদিকে ভারতীয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতার অক্ষমতা পরবর্তীকালে অন্যান্য শক্তিকে ভারত অভিযানে প্রলুব্ধ করেছিল ।

error: Content is protected !!