চোল সাম্রাজ্য
Contents
চোল সাম্রাজ্য
চোল রাজবংশের উত্থান সুদূর দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । কেবল রাজনৈতিক সংহতি নয় , শিল্প , সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রেও চোল রাজাদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দে কারিকল পেনার ও ভেলার নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে চোল শাসনের সূচনা করেন । কিন্তু চের , পাণ্ড্য ও পল্লবদের ক্রমাগত আক্রমণে এক শতকের মধ্যেই চোল রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায় । নবম খ্রীষ্টাব্দে পল্লব বংশের পতন শুরু হলে বিজয়ালয় এর নেতৃত্বে চোল বংশের পুনরভ্যুত্থান ঘটে ( ৮৫০ খ্রীঃ ) । তবে দক্ষিণ ভারতে চোল বংশের প্রকৃত আধিপত্য শুরু হয় প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালে ( ৯০৭-৯৪৬ খ্রীঃ ) । তিনি উত্তরে নেলোর পর্যন্ত চোল রাজ্য বিস্তার করেন । তবে পরবর্তী দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে চোল শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে । আবার দশম খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে প্রথম রাজরাজ এর নেতৃত্বে চোল বংশ পুনরায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে ।
প্রথম রাজরাজ
প্রথম রাজরাজ ( ৯৮৫-১০১৩ খ্রীঃ ) ছিলেন চোল বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক । তাঁর তাঞ্জোর লিপি থেকে রাজরাজের সামরিক অভিযানের সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ।
সর্বপ্রথম রাজরাজ ত্রিবান্দ্রামের নিকট চেরগণকে পরাজিত করেন । এরপর পাণ্ড্যদের পরাজিত করে তিনি মাদুরা দখল করেন । চালুক্যদের পরাজিত করে বেঙ্গীও তিনি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । তাঁর অন্যতম কীর্তি ছিল শক্তিশালী চোল নৌ বাহিনীর প্রতিষ্ঠা । এর সাহায্যে তিনি সিংহলের রাজধানী স্থাপন করেন । সিংহলে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয় , তিনি প্রাচীন ‘ দ্বাদশ সহস্র দ্বীপপুঞ্জে ‘ নৌ অভিযান প্রেরণ করেছিলেন । বর্তমানে ঐতিহাসিকরা ‘ দ্বাদশ সহস্র দ্বীপপুঞ্জ ’ বলতে বর্তমানে মালদ্ধীপ ও লাক্ষাদ্বীপ অঞ্চলকে নির্দিষ্ট করেছেন ।
শিল্প-স্থাপত্য ও সাহিত্যের প্রতিও তার গভীর অনুরাগ ছিল । শৈব ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাবান ছিলেন । তাঞ্জোরের সুবিখ্যাত রাজরাজেশ্বর মন্দির তাঁরই কীর্তি ।
প্রথম রাজেন্দ্র চোল
প্রথম রাজরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র ( ১০১৪-১০৪৪ খ্রীঃ ) সিংহাসনে বসেন । তিনি ছিলেন চোল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি । । কন্যাকুমারী , মহেন্দ্রগিরি এবং সুর অঞ্চলে প্রাপ্ত লিপি সমূহ থেকে তাঁর সামরিক কীর্তির কথা জানা যায় । সিংহাসনে বসেই তিনি পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে অগ্রসর হন এবং একাধিক সামরিক সাফল্যের ধারা চোল শক্তিকে অপ্রতিহত করে তোলেন ।
রাজ্য বিস্তার :
প্রথম রাজেন্দ্র পাণ্ড্য ও চের ( কেরল ) রাজ্য দুটিকে পরাজিত করে চোল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন এবং ঐ রাজ্য দুটিতে নিজ পুত্রকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন । সিংহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলও তিনি নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । চালুক্যদের পরাজিত করে তিনি হায়দ্রাবাদে চোল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ।
দক্ষিণ ভারত বিজয় সম্পূর্ণ করে প্রথম রাজেন্দ্র উত্তর ভারত বিজয়ে অগ্রসর হন । তিনি কলিঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করেন । পূর্ববঙ্গের শাসক গোবিন্দ চন্দ্র , পশ্চিমবঙ্গের মহীপাল এবং দক্ষিণবঙ্গের রণসূর প্রথম রাজেন্দ্রর নিকট পরাজিত হন । বঙ্গ বিজয়ের পর তিনি ‘ গঙ্গাইকোন্ড চোল ’ অর্থাৎ গঙ্গা বিজেতা চোল— এই উপাধি গ্রহণ করেন । এর অব্যবহিত পরেই তিনি কাবেরী নদীর তীরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । এর নাম হয় গঙ্গাইকোন্ড চোলপুরম ।
নৌ অভিযান :
প্রথম রাজেন্দ্রর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল পূর্ব এশিয়ার শক্তিশালী শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নৌ অভিযান । শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য ‘ শ্রীবিজয় ’ নামেও পরিচিত ছিল । শৈলেন্দ্র রাজা বিজয় তুঙ্গবৰ্মন রাজেন্দ্রর নিকট পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন । এর ফলে শৈলেন্দ্র রাজ্যের মধ্য দিয়ে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ চীনদেশে যাতায়াত করতে পারে । ১০৪৪ খ্রীষ্টাব্দে চালুক্যদের সাথে এক যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় প্রথম রাজেন্দ্র মৃত্যু মুখে পতিত হন ।
পরবর্তী রাজাগণ
প্রথম রাজেন্দ্রর মৃত্যুর পর চোল সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি শুরু হয়েছিল । তাঁর পুত্র প্রথম রাজাধিরাজ ( ১০৪৪-৫২ খ্রীঃ ) চের , চালুক্য ও পাণ্ড্য রাজ্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন । সিংহলের বিরুদ্ধেও তিনি অভিযান প্রেরণ করেন । রাজাধিরাজের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নৃপতি ছিলেন বীর রাজেন্দ্র ( ১০৪৬-০৭ খ্রীঃ ) । তিনি চালুক্যদের বিরুদ্ধে জয়ের স্মৃতি স্বরূপ তুঙ্গভদ্রার তীরে একটি বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন ।
চোল নৃপতি কুলোতুঙ্গের রাজত্বকালে ( ১০৭০-১১২০ খ্রীঃ ) চোল-চালুক্য সংঘর্ষ কিছুটা কমেছিল । কারণ তাঁর মহিষী ছিলেন চালুক্য রাজকন্যা । অবশ্য পরবর্তী শাসকদের আমলে চোল-চালুক্য সংঘর্ষ আবার বৃদ্ধি পেয়েছিল । তাসত্ত্বেও দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত চোল শক্তি টিকেছিল । ইতিমধ্যে যাদব ও কাকতীয় বংশ দক্ষিণ ভারতে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল । তাদের আক্রমণে শেষ পর্যন্ত চোল শাসনের অবসান ঘটে ।