মাৎস্যন্যায় কি
মাৎস্যন্যায় কি
গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে ( ৬৩৭ খ্রীঃ ) গৌড়বঙ্গে এক চরম অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল । বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত প্রায় একশত বৎসর ধরে এই অরাজক অবস্থা চলতে থাকে । ‘ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় , তখন গৌড় রাজ্য পাল বংশের প্রাক্কালে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে একাধিক ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাজ্যের উৎপত্তি ঘটেছিল । হিউয়েন সাং বাংলা পরিভ্রমণে এসে ( ৬৩৮ খ্রীঃ ) পুণ্ড্রবর্ধন ( উত্তরবঙ্গ ) , সমতট অবস্থা( দক্ষিণবঙ্গ ) , তাম্রলিপ্ত ( তমলুক ) ও কর্ণসুবর্ণ ( পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভাগ ) এই চারটি স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন ।
গৌড় রাজ্যের ভাঙনের পরে গড়ে ওঠা আঞ্চলিক রাজ্যগুলির মধ্যে বিবাদ ক্রমশ লেগেই ছিল । অনিয়ম , অনাচার ছিল স্বাভাবিক ঘটনা । গৃহ যুদ্ধ , দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ছিল সাধারণ ঘটনা । এইরূপ অভ্যন্তরীণ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে একাধিক বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ বাংলার জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । জয়নাগ নামক কোনো এক ব্যক্তি কিছুদিনের জন্য বাংলায় শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন ঠিকই , কিন্তু তার মৃত্যুর পর পুনরায় অব্যবস্থা চরমে ওঠে ।
এই সময়ে উত্তর ও পূর্ব ভারত তিব্বতীয় অভিযানে পরাজিত হয় । কনৌজের যশোবর্মন ও কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্য এর বারবার আক্রমণ বাংলাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে । তিব্বতীয় ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তৎকালীন বাংলার অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন , “ তখন বাংলার কোন রাজা ছিল না ; প্রত্যেক ক্ষত্রিয় , ব্রাহ্মণ , সামন্ত ও বণিক নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেন । ফলে জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত ছিল না । ”
শশাঙ্কের মৃত্যু ও পাল বংশের অভ্যুত্থানের মধ্যবর্তীকালীন বাংলার এই অরাজক অবস্থাকে সমসাময়িক লিপি ও কাব্যে ‘মাৎস্যন্যায়’বলে বর্ণনা করা হয়েছে । পুকুরের বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে নির্বিচারে গ্রাস করে , তেমনি অরাজকতার সুযোগে বাংলাদেশে সবলের দুর্বলের উপর যথেচ্ছ শোষণ চালাত । তাই এই সময়কে মাৎস্যন্যায় বলে অভিহিত করা হয়েছে । সেই অরাজক অবস্থাকে ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ ‘ গৌড়তন্ত্র ’ নামে অভিহিত করেন ।