গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা
Contents
গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা
কেবল বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠন নয় , সেই সাম্রাজ্যকে সুশাসনের দ্বারা সংহত ও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রেও গুপ্ত রাজারা যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন । গুপ্তদের সুদক্ষ শাসনে সারাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা , আর্থিক সাচ্ছল্য , ধর্মীয় স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্থিরতা পরিলক্ষিত হয়েছিল ।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা
স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র :
গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার প্রধান পুরুষ ছিলেন সম্রাট । তিনি ছিলেন আইন , বিচার ও প্রশাসনের সর্বময় প্রভু । গুপ্ত রাজারা ‘ দৈব সত্ত্বে ’ বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁরা ‘ পরম ভট্টারক ’ ‘ অচিন্ত্য পুরুষ ’ , ‘ পরমেশ্বর ’ , ‘ মহারাজাধিরাজ ’ প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতেন । সমুদ্রগুপ্ত নিজেকে ইন্দ্র , বরুণ প্রভৃতি দেবতার সাথে তুলনা করেছেন ।
সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও গুপ্ত রাজারা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না । বিভিন্ন স্তরের বহুসংখ্যক কর্মচারীর মাধ্যমে গুপ্ত রাজারা শাসন পরিচালনা করতেন । কারণ বিভিন্ন স্তরের কর্মচারী ও মন্ত্রীরা শাসনুকাজে বিশেষ কর্তৃত্ব ভোগ করতেন । তা ছাড়া , রাজা ইচ্ছামত আইন প্রণয়ন করতে পারতেন না । ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী শাসন রীতি গ্রহণে তিনি বাধ্য ছিলেন । সর্বোপরি স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন সংস্থাগুলি বা বণিক-কারিগরদের নিগমগুলি ( guilds ) স্থানীয় ও স্ব স্ব স্বার্থ সংক্রান্ত কাজে যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করত।
কর্মচারীবৃন্দ :
রাজাকে সাহায্য করার জন্য মন্ত্রী , যুবরাজ ও রাজকর্মচারী নিযুক্ত হতেন । মন্ত্রীপদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল বংশানুক্রমিক । মন্ত্রীরা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজকর্মচারী । এছাড়া , মহাবলাধিকৃত বা প্রধান সেনাপতি , মহাপ্রতিহার বা দ্বাররক্ষক , মহাদণ্ডনায়ক বা সেনাপতি , সন্ধিবিগ্রহিক বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রভৃতি ছিলেন উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রীয় রাজকর্মচারী । অক্ষ-পটলাধিকৃত নামক কর্মী সরকারি দলিলপত্র রচনা ও রক্ষা করতেন ।
এই সকল উচ্চপদের ক্ষেত্রেও বংশানুক্রমিক নির্বাচনের প্রবণতার প্রমাণ পাওয়া গেছে । তবে এর পরিণতি সব সময় ভাল হয়নি । কারণ বংশানুক্রমিক নির্বাচন রীতির ফলে মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের যোগ্যতা বিচার করা যেত না । গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য লোক নিযুক্ত থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই , গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার বাঁধন ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল । কুমারমাত্য ও আয়ুক্ত নামক কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের মধ্যে যোগসূত্র বজায় রাখতেন । সম্ভবত যুবরাজ কুমারেরা এই পদে নিযুক্ত হতেন ।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা
‘ দেশ ’ বা ‘ ভুক্তি ’ :
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল । এগুলিকে বলা হত ‘ দেশ ’ বা ‘ ভুক্তি । যেমন— সৌরাষ্ট্র দেশ , সুকুলি দেশ , তীরভুক্তি , পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি , অহিচ্ছত্রভুক্তি প্রভৃতি । ‘ দেশ ’ -এর শাসনভার গোপত্রি এবং ভুক্তির শাসনভার ‘ উপরিক মহারাজ ’ নামক কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত ছিল । দেশের শাসনভার মাঝে মধ্যে রাজকুমারদের হাতে দেওয়া থাকত । এঁরা ‘ মহারাজপুত্র দেবভট্টারক ‘ উপাধি গ্রহণ করতেন ।
বিষয় বা জেলা :
প্রতিটি প্রদেশ আবার একাধিক বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল । বিষয়ের শাসনভার ছিল ‘ বিষয়পতি ‘ বা আয়ুক্তদের উপর । বিষয়পতিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাদেশিক শাসক দ্বারা নির্বাচিত ও নিয়ন্ত্রিত হতেন । তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সম্রাট স্বয়ং বিষয়পতিদের নিয়োগ করতেন । বিষয়পতিদের সাহায্য করার জন্য অধিকরণ বা পরিষদ নামক একটি বেসরকারি সভা থাকত । প্রধান ব্যবসায়ী , নগরশ্রেষ্ঠী , প্রধান কারিগর প্রভৃতিদের নিয়ে এই সভা গঠিত হত । তবে এইসকল সদস্য মনোনীত হতেন কিংবা নির্বাচিত হতেন , তা জানা যায় না । তবে এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে গুপ্ত রাজাদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে । এদের পরামর্শক্রমে শাসনকার্য পরিচালিত হত । গুপ্ত সম্রাটেরা সাধারণত প্রদেশ বা জেলা শাসনে হস্তক্ষেপ করতেন না ।
গ্রাম শাসন :
গুপ্ত শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম । এর শাসনভার ছিল গ্রামিক বা গ্রামাধ্যক্ষ নামক কর্মচারীদের উপর । গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে গঠিত সভা ‘ পঞ্চমণ্ডলী ’ নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গ্রামিককে সাহায্য করত । এরাও স্থানীয় বিষয়াদি যথা— শিক্ষা , পথ , শান্তি প্রভৃতি বিষয়ে নজর রাখত ।
নগর শাসন :
গুপ্তযুগে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় । তবে , বৃহৎ নগরগুলিতে এক ধরনের স্থানীয় প্রতিনিধি সভা মারফত শাসন পরিচালনা করা হত । এগুলিকে বলা হত ‘ নিগম সভা ‘। শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এই সভায় প্রতিনিধিত্ব করতেন । নগরবাসীদের সুখ সুবিধার ব্যবস্থা করাই ছিল সভার কাজ । এই সভার পরামর্শক্রমে ‘ পুরপাল ’ নগর শাসন পরিচালনা করতেন । কোন কোন ক্ষেত্রে ‘ পুরপাল উপরিক ’ উপাধিধারী কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায় ।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা
গুপ্ত যুগে ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিচার পৃথকভাবে সম্পন্ন হত । প্রদেশ জেলাসমূহে সরকার বিচারালয় স্থাপিত ছিল । এই যুগে কাত্যায়ন , বৃহস্পতি , যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখ আইনগ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন । আইন মানা রাজা ও বিচারকের পালনীয় কর্তব্য ছিল । রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক ।
গ্রামে ও জেলায় স্থানীয় সভাগুলি বিচারকার্য সম্পন্ন করত । গুপ্তযুগে এক ধরনের গণ আদালতের অস্তিত্ব ছিল । ফা হিয়েনের বিবরণ থেকে জানা যায় , সে যুগে দণ্ডদানের কঠোরতা হ্রাস পেয়েছিল । অঙ্গচ্ছেদ বা প্রাণদণ্ড দেওয়া হত না ।তবে গবেষণার ফলে এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে । মুদ্রারাক্ষস নাটকে প্রাণদণ্ড বা বধ্যভূমির উল্লেখ পাওয়া যায় । স্কন্দগুপ্তের জুনাগড় লিপি থেকেও নিষ্ঠুর শাস্তিদানের কথা জানা যায় ।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যবস্থা
রাজস্ব হিসেবে উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজকোষে জমা দিতে হত । এছাড়া , কর্মচারীদের বেতনের উপর কর , বাণিজ্য ও শিল্পদ্রব্য থেকে শুল্ক , ফেরীঘাট থেকে কর প্রভৃতি রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত । ভূমি রাজস্বকে বলা হত ভাগ । বিষ্টি নামক ‘বেগার গ্রহণ’ তখন রীতি ছিল । যুদ্ধ ইত্যাদি প্রয়োজনে ‘মল্লকর ’ নামক অতিরিক্ত কর আদায় করা হত ।
সামরিক বাহিনী
গুপ্ত রাজাদের এক সুবিশাল , সুশিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী ছিল । পূর্বের মত এই বাহিনী পদাতিক , অশ্ববাহিনী , হস্তিবাহিনী ও নৌবাহিনী — এই চারভাগে বিভক্ত ছিল । উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীদের মধ্যে মহাদণ্ড নায়ক , মহাবলাধিকৃত , সন্ধিবিগ্ৰহিক প্রভৃতি ছিলেন প্রধান । সে যুগে প্রধান যুদ্ধাস্ত্র ছিল বর্শা , তীর-ধনুক , কুঠার , তরবারি প্রভৃতি । গুপ্ত যুগে নৌ-বাহিনী যে বেশ শক্তিশালী ও সংহত ছিল তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায় ।
উপরিলিখিত আলোচনা থেকে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে , গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা ছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংগঠিত । এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন । এইভাবে জনপ্রতিনিধিদের উপর শাসনভার ন্যস্ত করে গুপ্ত রাজারা এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন । এইরূপ জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা থাকার ফলেই দীর্ঘকাল বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।