ইতিহাস

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

Contents

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

মৌর্য শাসন ব্যবস্থার মূল কাঠামো রচিত হয়েছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যসম্রাট অশোকের প্রবর্তিত ব্যবস্থাদি দ্বারা । মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের প্রধান উপাদান হল মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ , কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং অশোকের শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি সমূহ । 

মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা

রাজার একক কর্তৃত্ব :

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় সম্রাট ছিলেন অপরিমিত ক্ষমতার অধিকারী । তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ শাসন , প্রধান আইন প্রণেতা এবং প্রধান বিচারপতি ও প্রধান সেনাপতি । মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় , মৌর্য সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে রাজকর্তব্য পালন করতেন । সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন , কর্মচারীদের কাজের তত্ত্বাবধান করতেন এবং রাজসভায় নিয়মিত উপস্থিত থেকে প্রজাদের অভিযোগ শুনতেন ও প্রতিকার করতেন । 

প্রধান বিচারক হিসাবে সম্রাট যেমন স্বয়ং বিচারকার্য পরিচালনা করতেন তেমনি প্রধান আইনপ্রণেতা হিসেবে সম্রাটের কাজ ছিল সমগ্র দেশের প্রয়োজনে আইনের খসড়া রচনা করা ও তা প্রয়োগ করা । এছাড়া প্রধান সেনাপতি হিসেবে সম্রাট যুদ্ধ সংক্রান্ত নির্দেশ দিতেন এবং প্রয়োজনে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন । 

মন্ত্রিণ :

সুবিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা একা রাজার পক্ষে সম্ভব ছিল না , তাই মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় , বহু দায়িত্বশীল কর্মচারীর উল্লেখ পাওয়া যায় । মৌর্য রাজকর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন ‘ অমাত্য ‘ বা সচিবগণ । এই অমাত্যদের মধ্যে যারা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাদের বলা হত ‘ মন্ত্রিণ’ । চারিত্রিক দৃঢ়তা ও যোগ্যতার বিচারেই মন্ত্রিণ নিযুক্ত হতেন । রাজ্যশাসন সম্পর্কিত ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে রাজা কয়েকজন মন্ত্রিণ এর সাথে অবশ্যই আলোচনা করে নিতেন । এঁদের বাৎসরিক বেতন ছিল ৪৮,০০০ পান । 

মন্ত্রিপরিষদ :

মৌর্য শাসনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ‘ মন্ত্রিপরিষদ ’ । নানা ধরনের অমাত্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের রাজা নিযুক্ত করতেন । এদের বাৎসরিক বেতন ছিল ১২,০০০ পান । মন্ত্রিপরিষদের স্থান ছিল মন্ত্ৰিণদের নীচে । রাজা জরুরি প্রয়োজনে এই পরিষদের সাথে পরামর্শ করতেন । আলোচনাকালে মন্ত্রিগণও পরিষদের অধিবেশনে আমন্ত্রিত হতেন । অবশ্য মতামতগ্রহণে রাজার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল । 

অধ্যক্ষ মণ্ডলী :

শাসন ও বিচার বিভাগের উচু পদগুলিতে আর এক শ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত হতেন । এঁদের বলা হত অধ্যক্ষ । নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্যদেরই অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হত । যেমন অর্থ সংক্রান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অমাত্য অর্থ দপ্তরের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হতেন । অর্থশাস্ত্রে ৩২ টি অধ্যক্ষ পদের উল্লেখ পাওয়া যায় । এদের মধ্যে নগরাধ্যক্ষ , বলাধ্যম, রথাধ্যক্ষ , অশ্যধ্যক্ষ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়া পুরোহিত , যুবরাজ , প্রতিহার , ( রাজার দেহরক্ষী ) অন্তরবংশিক প্রভৃতি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতেন । 

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা 

মৌর্য সাম্রাজ্যকে কয়েকটি শাসনতান্ত্রিক এককে ( Administrative unit ) বিভক্ত করা হয়েছিল । চন্দ্রগুপ্তের আমলে এই ধরনের চারটি একক বা প্রদেশ ছিল , যথা — উত্তরাপথ , দক্ষিণাপথ, প্রাচ্যঅবন্তী । পরে অশোক কলিঙ্গ প্রদেশ যুক্ত করেন । এদের রাজধানী ছিল যথাক্রমে তক্ষশীলা ,সুবর্ণগিরি , পাটলিপুত্র , উজ্জয়িনী এবং তোসালী । প্রাদেশিক শাসকেরা রাজা কর্তৃক মনোনীত হতেন । ‘ মহাপাত্র ’ নামক কর্মচারীদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে প্রদেশ কর্তাগণ শাসন পরিচালনা করতেন । 

প্রতিটি প্রদেশ আবার কতকগুলি জেলা বা জনপদে বিভক্ত ছিল । জনপদের শাসন পরিচালনা করতেন ‘ সমাহতা ’ নামক কর্মচারীগণ । এদের সহায়তা করতেন ‘ প্রদেশস্ট্রী” নামক কর্মচারীগণ । শাসন ব্যবস্থার সব থেকে ক্ষুদ্র একক ছিল গ্রাম । গ্রামের শাসনভার গ্রামীকদের উপর ন্যস্ত ছিল । গ্রামগুলিতে সম্ভবত স্ব-শাসন প্রবর্তিত ছিল এবং গ্রামীকগণ নির্বাচিত হতেন । এঁরা গ্রাম্য রাজস্বের একটা অংশ বেতন হিসেবে ভাগে করতেন । পাঁচ বা দশটি গ্রামের উপরে ছিলেন ‘ গোপ ’ নামক কর্মচারী । 

মৌর্য সাম্রাজ্যের পৌর শাসন ব্যবস্থা  

মৌর্যযুগে নগর শাসনের এক বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে । তখন পাটলিপুত্র নগর শাসনের জন্য ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি নগর পরিষদ ছিল । প্রতিটিতে পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই পরিষদ আবার ছয়টি শাখায় বিভক্ত ছিল । এদের এক-একটি শাখা এক-একটি বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত ছিল । যেমন— 

( ১ ) শিল্প কার্যের তত্ত্বাবধান করা , 

( ২ ) বিদেশীদের গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ করা , 

( ৩ ) জন্ম-মৃত্যুর হিসেব রাখা , 

( ৪ ) ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা , 

( ৫ ) পণ্যসামগ্রীর বিক্রয়ের তত্ত্বাবধান করা এবং 

( ৬ ) কর আদায় করা ।  

সম্ভবত তক্ষশীলা , উজ্জয়িনী , কোশাম্বী প্রভৃতি শহরেও অনুরূপ পৌর শাসন প্রচলিত ছিল । 

সামরিক পরিষদ 

পৌর শাসনের মত সামরিক শাসনও এিশ সদস্যের একটি পরিষদের উপর নাস্ত ছিল । প্রতিটিতে পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই পরিষদও ছয়টি ভাগে বিভক্ত ছিল । এক-একটি বিভাগ এক-একটি বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত ছিল , যেমন— ( ১ ) পদাতিক , ( 2 ) অশ্বারোহী , ( ৩ ) হস্তি বাহিনী , ( ৪ ) যুদ্ধরথ , ( ৫ ) নৌ বাহিনী এবং ( ৬ ) রসদ ও যানবাহন । ব্রাহ্মণ , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য ও শূদ্র সমাজের চারটি শ্রেণী থেকেই সৈন্য নিয়োগ করা হত । তীর-ধনুক , বর্শা , কুঠার , তরবারি ও স্থানযন্ত্র এবং ‘ চলযন্ত্র ছিল মৌর্যযুগের প্রধান যুদ্ধাস্ত্র । 

মৌর্য সাম্রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা 

বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং । তিনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও অমাত্যদের সাহায্যে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন । অর্থশাস্ত্রে ‘ ধর্মস্থীর ‘ ও ‘ কণ্টক শোধন ‘— এই দু’ধরনের বিচারালয়ের উল্লেখ আছে । এছাড়া , তিন ধরনের নিম্ন বিচারালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় , যথা— ‘স্থানীয় ‘ , দ্রোণমুখ ’ ও ‘ সংগ্রহণ ‘ । মৌর্যযুগে দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল । জরিমানা , অঙ্গচ্ছেদ এবং শিরচ্ছেদ শাস্তি হিসেবে দেওয়া হত । ব্রাহ্মণগণও গুরুদণ্ড থেকে রেহাই পেতেন না । 

গুপ্তচর ব্যবস্থা 

মৌর্য শাসনে গুপ্তচরদের বিশেষ ভূমিকা ছিল । অর্থশাস্ত্রে ‘ সমস্থা ’ ও ‘ সঞ্চরা ’ নামক দু’ধরনের গুপ্তচরের উল্লেখ আছে । স্ট্রাবো ‘ পরিদর্শক ‘ নামে একশ্রেণীর গুপ্তচরের উল্লেখ করেছেন । 

রাজস্ব ব্যবস্থা 

রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব । প্রধানত ‘ বলি ’ ও ‘ ভাগ ’ এই দু’ধরনের রাজস্ব ছিল । ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ কর হিসেবে নেওয়া হত । এছাড়া বাণিজ্য শুল্ক , জন্ম-মৃত্যু কর , শুল্ক কর প্রভৃতি রাজস্ব হিসেবে গৃহীত হত ।  

অশোকের সংযোজন 

চন্দ্রগুপ্তের শাসন কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে সম্রাট অশোক তার জনকল্যাণ আদর্শ কর্মসূচীকে রূপায়িত করার জন্য কয়েকটি নতুন পদের সৃষ্টি করেছিলেন । তার সময়ে রাজুক , যুত প্রভৃতি কর্মচারী প্রদেশে নিযুক্ত হতেন । এরা প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর দেশভ্রমণে বের হয়ে প্রজাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকার করতেন । ‘ ধর্মমহামাত্র ‘ নামক কর্মচারী প্রজাদের ধর্মমুখী করার কার্যে নিযুক্ত থাকতেন । এ ছাড়া অশোক ‘নগর ব্যবহারিক ‘ , ‘ প্রতিবেদক ‘, ‘ ব্রজভূমিক ‘ নামক কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন । অশোক দণ্ডবিধির কঠোরতা বহুল পরিমানে হ্রাস করেন এবং মানুষ ও পশুর মঙ্গল সাধনকেই রাজকর্মচারীদের প্রধান কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন । 

মৌর্য শাসনের প্রকৃতি 

মৌর্য রাজারা একক ক্ষমতার অধিকারী হলেও তারা স্বৈরাচারী ছিলেন না , স্বেচ্ছাচারী তো নয়-ই । মন্ত্রিন বা মন্ত্রিপরিষদের মত গ্রহণ রাজার পক্ষে বাধ্যতামূলক ছিল না সত্য , কিন্তু যেহেতু প্রজানুরঞ্জন ছিল মৌর্য রাজতন্ত্রের আদর্শ , তাই রাজারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিষদের মতামতকে মর্যাদা দিতেন । তা ছাড়া , কয়েকটি পরোক্ষ নির্দেশিকাও রাজার কাজকে নিয়ন্ত্রিত করত । যেমন- 

( ১ ) রাজা দেশের প্রচলিত রীতিনীতি ( পুরাণ-প্রকৃতি ) মেনে চলতে বাধ্য ছিলেন , 

( ২ ) ধর্মশাস্ত্রে রাজকর্তব্যের যে আদর্শ উল্লেখ ছিল , তা রাজা লঙ্ঘন করতেন না ,

( ৩ ) সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ পরামর্শদাতারা রাজাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন । 

মৌর্য শাসনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল স্বায়ত্ত শাসনের প্রয়োগ । নগরগুলিতে পৌর শাসন এবং গ্রামগুলিতে স্ব-শাসনের যে প্রচলন ছিল , — এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । এককথায় মৌর্য যুগে এক উন্নত ধরনের বিকেন্দ্রীকৃত ও স্বায়ত্ত শাসনযুক্ত প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল ।

error: Content is protected !!