ইতিহাস

অশোকের শিলালিপি

অশোকের শিলালিপি

অশোকের রাজত্বকালে সব থেকে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক উপাদান হল তাঁর শিলালিপি সমূহ । শিলালিপিগুলি থেকে একদিকে যেমন অশোকের ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে বহু তথ্য জানা যায় , অন্যদিকে তেমনি এগুলি তার রাজ্যসীমা নির্ধারণ , প্রতিবেশীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক , সেকালে শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার প্রভৃতি নানা বিষয় জানতে সাহায্য করে ।

অশোকের লিপিগুলি প্রধানত পাহাড়ের গায়ে , স্তম্ভের উপর ও গুহার গায়ে উৎকীর্ণ ছিল । তাই এগুলিকে মূল তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে , যথা — শিলালেখ ( Rock Edict ) , স্তম্ভলেখ ( Pillar Edict ) এবং গুহালেখ ( Cave Edict ) । শিলালেখ ও স্তম্ভলেখগুলি পাওয়া গেছে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে জনবসতিপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সমূহে ।  

অশোকের অনুশাসনগুলি মূলত ‘ প্রাকৃত ‘ভাষায় লিখিত । কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি গ্রীক ভাষা বা ‘ আরামাইক  ’ ভাষা ব্যবহার করেছেন । তাঁর ব্যবহৃত লিপির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘ ব্রাহ্মী লিপি ‘ । ভারত ও নেপালে প্রাপ্ত  লেখগুলিতে ব্রাহ্মী লিপির প্রাধান্য দেখা যায় । উত্তর পশ্চিম ভারতে গ্রীকদের জনবসতির কারণে সম্ভবত ঐ অঞ্চলের অনুশাসনে গ্রীক বা আরামাইক ভাষার প্রাধান্য দেখা যায় । এই অঞ্চলে তিনি ‘ খরোষ্ঠী ’ লিপি ব্যবহার করেছেন । আরামাইক লিপির বিবর্তিত রূপই হল খরোষ্ঠী লিপি ।  

১৮৩৭ সালে কলিকাতা মিন্টের কর্মচারী ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম অশোকের লেখর পাঠোদ্ধার করেন । এই ব্যাপারে প্রিন্সেপের সহযোগী ছিলেন ল্যাসেন , কানিংহাম প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত ।  

অশোকের প্রধান শিলালেখ এর সংখ্যা চৌদ্দ । এই লেখগুলিতে চৌদ্দটি করে অনুশাসন লিপিবদ্ধ আছে । এগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে পেশোয়ার জেলার অন্তর্গত শাহবাজগড়ি , হাজারা জেলার মানসেরা , বর্তমান দেরাদুনের নিকটবর্তী গিরনার , থানা জেলার সোপারা , গঞ্জাম জেলার জৌগড় , পুরী জেলার ধৌলী এবং মাদ্রাজ্যের কুরনুল জেলার অন্তর্গত এরাগুড্ডি নামক স্থান সমূহে । তবে জৌগড় ও ধৌলী , লেখতে অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ সংক্রান্ত ও পরবর্তীকালে কর্মচারীদের অনুসরণীয় একাধিক নির্দেশ লিপিবদ্ধ আছে । কলিঙ্গ যুদ্ধের পর এই দুটি খোদিত হয়েছিল । তাই এই দুটি ‘ কলিঙ্গ লেখ ’ নামেও পরিচিত ।  

অশোকের অপ্রধান শিলালেখ মাত্র দুটি । এগুলি পাওয়া গেছে জব্বলপুর জেলার রূপনাথ ও জয়পুরের বৈরাটে । তবে এগুলি প্রধান শিলালেখর মত পরস্পরের সাথে যুক্ত নয় । এর নির্দেশগুলি সংক্ষিপ্ত । এগুলির ভাষান্তর পাওয়া গেছে শাহাবার জেলার সাসারাম , রায়চুর জেলার মাস্কী , চিতলদ্রুগ জেলার সিদ্দপুর , ব্রহ্মগিরি ও জটিল-রামেশ্বর প্রভৃতি স্থানে ।একমাত্র মাস্কী লেখতেই অশোকের নাম পাওয়া গেছে । ( দেবানাং পিয়স অশোকম ) । অন্যান্যগুলিতে কেবল ‘দেবানাং পিয় পিয়দর্শী এবম্ বাহ’ কথাগুলি উল্লেখ আছে । অতি সম্প্রতি শিহোর জেলার ( মধ্য প্রদেশ ) অন্তর্গত পাখুড়ারিয়া , বেলারি জেলার ( কর্ণাটক ) উড়েগোলাম প্রভৃতি স্থানে কয়েকটি অপ্রধান লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে ।  

অশোকের প্রধান স্তম্ভলেখটি পাওয়া গেছে দিল্লীতে । সম্ভবত সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক নিকটবর্তী তোপরা গ্রাম থেকে এটি এনেছিলেন । এতে সাতটি অনুশাসন লিপিবদ্ধ আছে । একই ধরনের ছয়টি অনুশাসন সম্বলিত আর একটি ফলক দিল্লীতে পাওয়া গেছে । ফিরোজ তুঘলক এটি মিরাট থেকে দিল্লীতে এনেছিলেন বলে অনুমান করা হয় । এলাহাবাদে অনুরূপ আর একটি স্তম্ভলেখ পাওয়া গেছে । এটি সম্ভবত আকবর কোশাম্বী থেকে এনেছিলেন । এছাড়া প্রথম ছয়টি লেখর ভাষান্তর চম্পারণ জেলার ( বিহার ) অন্তর্গত লৌরিয়া অররাজ , লৌরিয়া নন্দনগড় এবং রামপূর্বতে পাওয়া গেছে ।  

অশোকের অপ্রধান স্তম্ভলেখগুলি চারটি অনুশাসন সম্বলিত । এই ধরনের তিনটি স্তম্ভলেখ পাওয়া গেছে বারাণসীর নিকটবর্তী সারনাথে , ভূপালের অন্তর্গত সাঁচিতে এবং বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীতে । মগধ থেকে নেপাল যাওয়ার পথে এই তিনটি স্থানের অবস্থান । সম্ভবত অশোক গৌতম বুদ্ধের পুণ্য জন্মস্থান লুম্বিনী পরিদর্শনে এই পথ ধরে গিয়েছিলেন এবং তার সেই যাত্রাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে এই স্তম্ভগুলি স্থাপন করেছিলেন ।  

অশোকের গুহালেখ পাওয়া গেছে বিহারের গয়া জেলার অন্তর্গত বারবার পাহাড়ে । এর চারটি গুহার তিনটিতে অশোকের অনুশাসন উৎকীর্ণ আছে । আজীবিকদের জন্য অশোকের দানের কথা এই গুহালিপি থেকে জানা যায় ।

error: Content is protected !!