মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন কী
Contents
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন কী
মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন ( ১৯০৯ ) ভারতবাসীর দাবি পূরণ করেনি । প্রকৃতপক্ষে মর্লে বা মিন্টো কেউই ভারতে প্রকৃত পার্লামেন্টারি শাসন প্রবর্তনে আগ্রহী ছিলেন না । হাউস অব লর্ডস এ মর্লে এক ভাষণে ( ১৯০৭ খ্রিঃ ) বলেন , “ ভারতে সংসদীয় প্রথার প্রবর্তন সরকারের আদৌ উদ্দেশ্য নয় , যেজন্য আমি আগ্রহী হতে পারি । ” ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মিন্টো ভারত সচিবকে এক পত্রে লেখেন , “ আমি ভারতবর্ষে প্রতিনিধিমূলক সরকার পছন্দ করি না । ভারতের সরকার অবশ্যই স্বৈরতান্ত্রিক হবে ” ।
যাই হোক , জাতীয় কংগ্রেসে চরমপন্থী গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধি ও লক্ষ্ণৌ চুক্তি ( ১৯০৬ ) ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক নতুন প্রেরণা দান করে । লক্ষ্ণৌ চুক্তির দ্বারা কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন প্রথা মেনে নিয়ে এবং মুসলিম লিগ কংগ্রেসের ‘ স্বরাজ ‘ আদর্শ মেনে নিয়ে যৌথ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিলে ব্রিটিশ সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে ।
তবে বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ইংরেজ সরকার ভারতবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রসর হবেন এবং ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসনের দাবি মঞ্জুর করবেন — এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ভারতবাসী যুদ্ধ চলাকালীন ইংরেজ সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন । এই উপলক্ষ্যে ভাইসরয় চেমসফোর্ড ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে এক সরকারি প্রতিবেদনে যুদ্ধের সময় ভারতবাসীর সহযোগিতার পুরস্কার স্বরূপ প্রশাসনে ভারতবাসীর অধিকতর অংশপ্রদানের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেন ।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু ভারত সচিব নিযুক্ত হয়েই ভারতবাসীর দাবিপূরণে সচেষ্ট হন । কিন্তু তাঁর প্রধান সমস্যা ছিল ভারতবাসীর স্বশাসনের আদর্শের সাথে স্বৈরতন্ত্রী ইংরেজ শাসনের সমন্বয় সাধন করা । যাই হোক , ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ২০ শে আগস্ট মন্টেগু ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে , “ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে ভারতবাসী যাতে প্রশাসনের প্রতি বিভাগে অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করতে পারে এবং ক্রমশ স্বায়ওশাসন লাভের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে , এই হল ব্রিটিশ সরকারের লক্ষ্য ও নীতি । ”
অতঃপর মন্টেগু ভারতে এসে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল চেমসফোর্ড এর সঙ্গে আলোচনার পর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড রিপোর্ট প্রকাশ করেন । এরই ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে সংস্কার আইন পাস করেন , সেটাই মন্টেণ্ড চেমসফোর্ড আইন নামে খ্যাত ।
মন্টেণ্ড চেমসফোর্ড রিপোর্টে তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরীণ চরিত্রের একটি সুন্দর বিশ্লেষণ দেখা যায় । রিপোর্টে প্রধানত তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করা হয় ।
প্রথমত , বলা হয় , অধিকাংশ ভারতবাসী দরিদ্র , অজ্ঞ ও রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন । এরা অধিকাংশ গ্রামে বাস করে । ক্ষমতা হস্তান্তর হলে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও ক্ষমতাবান হবে ।
দ্বিতীয়ত , জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা ভারতীয় হিন্দুসমাজের বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করে রেখেছে ।
তৃতীয়ত , বলা হয় , হিন্দু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বিরোধ বর্তমান । তাই সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা জরুরি । ১৯১৯ এর সংস্কার আইনে ভারতশাসন পরিচালনার জন্য ইংল্যান্ডে যে শাসন কাঠামো ছিল , তার কিছু পরিবর্তন করা হয় । যথা—
( ১ ) ইতিপূর্বে ভারত সচিবের বেতন ও ভাতা ভারতীয় রাজস্ব থেকে দেওয়া হত । অতঃপর এই বেতন ও ভাতা ব্রিটিশ সরকার বহন করবেন ঠিক হয় ।
( ২ ) ভারত সচিবের কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে অন্তত ১০ জন এবং অনধিক ১২ জন করা হয় ।
( ৩ ) মোট সদস্যের অন্তত অর্ধেক এমন ব্যক্তি হবেন যারা দীর্ঘদিন ভারতে বসবাস করেছেন । এঁদের কার্যকলাপ হবে ৫ বছর ।
( ৪ ) ভারতের রাজস্ব সংক্রান্ত প্রস্তাব অধিকাংশের ভোটে পাস করা বাধ্যতামূলক করা হয় ।
কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক বিভাগ
এই আইনে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলিকে ‘ কেন্দ্রীয়’ও ‘ প্রাদেশিক ’ – এই দুই ভাগে ভাগ করা হয় । কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখা হয় দেশ রক্ষা , বৈদেশিক সম্পর্ক , ডাক ও তার , রেলওয়ে , মুদ্রা , বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয় । প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকল অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা , শিক্ষা , সেচ , জনস্বাস্থ্য , বিচার , স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বিষয়গুলি ।
দ্বি কক্ষ যুক্ত আইনসভা
নতুন আইনে কেন্দ্রে দুই ধরনের আইনসভা গঠন করা হল । উচ্চকক্ষের নাম হল কাউন্সিল অব স্টেট এবং নিম্নকক্ষের নাম হল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি । উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ৬০ । এদের মধ্যে ৩৩ জন নির্বাচিত এবং ২৭ জন গভর্নর জেনারেল কর্তৃক মনোনীত হবেন । সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচন বহাল রাখা হল এবং ভোটাধিকারের মাত্রা সীমাবদ্ধ করা হল । নিম্নকক্ষের মোট সদস্য হল ১৪৫ জন । এদের মধ্যে ১০৪ জন হবেন নির্বাচিত এবং ৪১ জন হবেন মনোনীত । এক্ষেত্রেও মুসলমান , শিখ , ইউরোপীয় প্রভৃতি সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হল ।
ক্ষমতা ভাগ
কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে সমগ্র ভারতের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখা হল । এই সদস্যগণকে প্রশ্ন উত্থাপন , বিতর্ক ও সংশোধন প্রস্তাব আনার অধিকার দেওয়া হল । তবে বিদেশনীতি , প্রতিরক্ষা , ধর্ম বা জাতীয় ঋণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য গভর্নর জেনারেলের পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক করা হল । গর্ভনর জেনারেলের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হল :
( ১ ) গভর্নর জেনারেলের ইচ্ছানুযায়ী কোনো আইন যদি আইনসভা পাস না করে , তবে তিনি নিজেই তা বলবৎ করতে পারবেন ।
( ২ ) ছয় মাসের জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারবেন ।
( ৩ ) আইনসভা কর্তৃক গৃহীত যে কোনো আইন তিনি সংশোধন বা নাকচ করতে পারবেন এবং
( ৪ ) পূর্বের মতো গভর্নর জেনারেল তাঁর কাজের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বা ভারত সচিবের নিকট দায়ী থাকবেন , ভারতের আইনসভার নিকট নয় ।
দ্বৈত শাসন
১৯১৯ এর সংস্কার আইনানুসারে প্রদেশগুলিতে ‘ যুগ্ম শাসননীতি ‘ ( Dyarchy ) প্রবর্তিত হল । ব্রহ্মদেশ ও উত্তরপ্রদেশ সহ গভর্নর শাসিত প্রদেশের সংখ্যা হল ১০ । প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়গুলিকে ‘ সংরক্ষিত ’ ও ‘ হস্তান্তরিত ‘ — এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হল । বিচার , পুলিশ , ভূমি রাজস্ব , কারাগার ও সেচ প্রভৃতি সংরক্ষিত বিষয়ের দায়িত্ব থাকল গর্ভনর ও তাঁর কাউন্সিল সদস্যদের হাতে । অপরদিকে শিক্ষা , জনস্বাস্থ্য , স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়গুলির দায়িত্ব রইল প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রীদের হাতে । মন্ত্রিসভা তার কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী রইল ।
সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত উভয় বিষয়ের ওপর গভর্নরের অবাধ কর্তৃত্ব বহাল রইল । হস্তান্তরিত বিষয় সম্পর্কে আলোচনা আইনসভা করতে পারত , কিন্তু সংরক্ষিত বিষয়ের ওপর আইনসভার কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ রাখা হল না । প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যসংখ্যাও বৃদ্ধি করা হল । এই সদস্যদের শতকরা ৭০ ভাগ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে এবং ৩০ ভাগ গভর্নরের মনোনয়নের দ্বারা আসবেন স্থির হল ।
মূল্যায়ন
মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় । এর ফলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে থাকে । কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতাগণ এই আইনকে ‘ নগণ্য ’ , ‘ অসন্তোষজনক ও নৈরাশ্য জনক ‘ বলে অভিহিত করেন । মুসলিম লিগও স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থাকে আরও সাম্প্রদায়িক করে শতকরা ৫০ ভাগ আসন এই পদ্ধতির অধীনে আনার দাবি জানায় । সব শ্রেণির মানুষই এই আইনের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন ।
প্রথমত , এই আইনের কেন্দ্রে প্রকৃত অর্থে কোনো দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা গঠনের পরিবর্তে গভর্নর জেনারেলের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল । গভর্নর জেনারেল তার ক্ষমতাবলে যে কোনো আইন পাস বা নাকচ করতে পারতেন , পরন্তু তিনি তাঁর কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী ছিলেন না । স্বভাবতই আইনসভা একটি অপ্রয়োজনীয় অলংকার মাত্রে পরিণত হয়েছিল । বস্তুত এই সংস্কার আইনে ভারতের শাসন কাঠামোর কোনোরূপ মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়নি । পূর্বেকার কেন্দ্রীভূত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনই বহাল ছিল ।
দ্বিতীয়ত , প্রদেশের ক্ষেত্রে যুগ্মশাসন বা Dyarchy প্রবর্তনের দ্বারা স্বায়ত্তশাসনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেও উপযুক্ত উদারতার অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল । প্রাদেশিক শাসনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি গর্ভনরের হাতেই ছিল । এ বিষয়ে আইনসভার কিছুই ক্ষমতা ছিল না । এমনকি হস্তান্তরিত বিষয়গুলিও গভর্নরের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্ধন , পরিবর্তন বা নাকচ করতে পারতেন ।
তা ছাড়া , মন্ত্রীরা কোনো বিশেষ সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত না হওয়ার ফলে মন্ত্রীদের মধ্যে কোনো যৌথ দায়িত্ববোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল না , যা যুগ্মশাসনের সফলতার জন্য ছিল অপরিহার্য শর্ত । আসলে সবকিছুই গর্ভনরের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল । এমনকি ভারতস্থ ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রও ভারতবাসীর এই সামান্য ক্ষমতালাভে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ।
তৃতীয়ত , এই আইনে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়নি । ফলে ভোটাধিকার মুষ্টিমেয় বিত্তবান লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল ।
চতুর্থত , সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল থাকার ফলে হিন্দু মুসলিম বিভেদ ও সংঘর্ষ বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ।
বস্তুতপক্ষে , মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনকে ভারতের স্বশাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলা যায় । ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও এই আইনেই প্রথম ভারতবাসীর হাতে কিছু ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল ।