ইতিহাস

ভারত বিভাগ কি অনিবার্য ছিল

ভারত বিভাগ কি অনিবার্য ছিল  

দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট মধ্যরাত্রে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করে । ভারত স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে দ্বিখণ্ডিতও হল । জন্ম নিল নতুন শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তান । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধ্বজাধারী ভারতবর্ষ তার ঐতিহ্য , গৌরব , সহনশীলতা ইত্যাদি মানবিক অতীতের কথা বিস্মৃত হয়ে মেনে নিল ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদ ।  

প্রশ্ন হল — ভারতবর্ষের এই বিভাজন কি অনিবার্য ছিল ? অনেকে মনে করেন , ভারত বিভাগ অবশ্যম্ভাবী ছিল না । জাতীয় নেতৃবৃন্দের ভুলভ্রান্তি এবং কয়েকজন নেতার ক্ষমতা লাভের দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা ও একগুঁয়ে মনোভাব ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তুলেছিল । দেশের সাধারণ মানুষ এই দুঃখজনক পরিণতির জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না । হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে নানাক্ষেত্রে অমিল ছিল । কিন্তু ভারত বিভাগের মতো মারাত্মক পরিণতি তাদের কাম্য ছিল না । যে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা ভেবে অদূরদর্শী ও ক্ষমতালোভী নেতৃবৃন্দ ভারত বিভাগের মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধান দেখেছিলেন , ভারত বিভাগের পর সবথেকে বিস্মৃত ও হতাশ হয়েছিলেন সেই সকল সাধারণ মানুষ ।  

সাধারণভাবে ভারত বিভাগের জন্য হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা জিন্নাহকে দায়ী করা হয়ে থাকে । কলকাতা হত্যাকাণ্ড ও দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের তীব্রতা প্রমাণ করেছিল হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে সহাবস্থান সম্ভব নয় । তাই ভারত বিভাগ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না ।  

আয়েশা জালাল মনে করেন , জিন্নাহ আন্তরিকভাবে দেশ বিভাগ চাননি । জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের , বিশেষত নেহরু ও প্যাটেলের সাথে তার ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল । মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর তিনি অনুভব করেন যে , ভারতের জাতীয় আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেসই প্রাধান্য পাচ্ছে । এই অবস্থায় তিনি মুসলিম লিগকে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে সমপর্যায়ভুক্ত করার লক্ষ্যে অগ্রসর হন ।  

কিন্তু যুক্তপ্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠনের সময় ( ১৯৩৭ খ্রিঃ ) কংগ্রেস লিগের দুজন সদস্যকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হলে লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয় । এরপর থেকেই হিন্দু মুসলমান ব্যবধান দিন দিন বাড়তে থাকে , যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলনকে জোরদার করে ভারত বিভাগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয় ।  

একথা অনস্বীকার্য , জাতীয় কংগ্রেস মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি । জিন্নাহ প্রমুখের বক্তব্য অনুযায়ী “ কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান ” হয়তো ছিল না । কিন্তু কংগ্রেস মুসলমানদের সাথে গণসংযোগ গড়তে পারেনি । তাই অমলেশ ত্রিপাঠী মক্তব্য করেছেন , “ কংগ্রেস প্রায় সকল স্বার্থ ও মতকে আপন জাতীয়বাদী ছত্রতলে আনতে সক্ষম হলেও মুসলমানদের ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছিল এবং সেই কারণেই দেশ বিভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল । ”

অনেকে মনে করেন , হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সত্ত্বেও ভারত বিভাগ এড়ানো যেত— যদি ইংরেজদের ‘ Divide and Rule ‘ নীতির মূল তত্ত্ব হিন্দু ও মুসলমান নেতারা অনুধাবন করতে পারতেন । ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখা । তাই তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করেছিল । এক্ষেত্রে চার্চিলের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ । রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে , এই উপমহাদেশে ব্রিটিশের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে হলে জিন্নাহর হাতে পাকিস্তান তুলে দেওয়া আবশ্যিক ।  

ভারত বিভাগের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে ভারতের সংগঠন হিসেবে কংগ্রেসের দায়িত্ব বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় । অনেকের মতে , কংগ্রেস ভারত বিভাগ চায়নি । কিন্তু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রণক্লান্ত কংগ্রেস নেতারা শেষ মুহূর্তেই ভারত বিভাগকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন । তাদের সংগ্রামী শক্তি তখন নিঃশেষিত আবার ক্ষমতার শীর্ষ থেকে নেমে যাওয়ার ইচ্ছাও তাদের ছিল না । এমতাবস্থায় ভারত বিভাগকে তারা অস্তিত্ব ও ক্ষমতা রক্ষার পথ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন । ভারত বিভাগের জন্য মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী ও ঐতিহাসিকেরা কংগ্রেসকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন ।  

এ প্রসঙ্গে হীরেন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : “ ভারত বিভাগ অনিবার্য ছিল না । এটি হিন্দু ও মুসলমানের স্বতন্ত্র জীবনধারার পরিণতিও ছিল না । এটি কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের ব্রিটিশ সরকারের সাথে যে কোনো মূল্যে সমঝোতার পরিণতি । ” 

মার্কসবাদীদের মতে , কংগ্রেস যদি ১৯৪৫-৪৬ এ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিকে সংযত করে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তুলত , তাহলে হয়তো ভারত বিভাগ এড়ানো যেত । কংগ্রেসের দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়েও তার পক্ষে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায় । যেমন— 

( ১ ) লিগের একগুঁয়েমির ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের অচলাবস্থা কংগ্রেসকে অসহায় করেছিল । প্যাটেল বলেছিলেন , লিগের নেতৃত্বে পাঞ্জাব ও বাংলার কার্যত একটি বিকল্প পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা ভোগ করছিল । 

( ২ ) ১৯৮৬ সালে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ , গণহত্যা , গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল । কংগ্রেসের মনে হয়েছিল , দেশ বিভাগ না হলে অকারণে বহু মানুষের প্রাণ যাবে । 

সুচেতা মহাজন লিখেছেনঃ “ পাকিস্তানের তুলনায় দেশীয় রাজ্যগুলির সমস্যা ভারতীয় ঐক্যের পথে বেশি ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছিল । ” তাই বলা চলে , ভারত ভাগের জন্য লিগ বা জিন্নাহ জাতীয় কংগ্রেস ও ইংরেজ এদের কেউই যেমন পুরোপুরি দায়ী নন , তেমন প্রত্যেকেই কিছু কিছু দায়ী । এদের কেউই প্রথমে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাননি । লিগ ও ইংরেজের কাছে পাকিস্তানের দায়ি ছিল তুরুপের তাস ।  

১৯৪০ এর লাহোর সিদ্ধান্ত ছিল কথামাত্র । কিন্তু এই বিপজ্জনক গোলা নিয়ে খেলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কেউই তাকে ধরে রাখতে পারেননি । শেষ মুহূর্তে প্রত্যেকের কাছেই ভারত বিভাগকে সব সমস্যা সমাধানের পথ বলে মনে হয়েছিল । দুঃখ এই যে , জিন্নাহ বা কংগ্রেস বা ইংরেজ তাদের তাৎক্ষণিক স্বার্থ ও অস্তিত্ব ভারত বিভাগের মাধ্যমেই রক্ষা করেছিলেন ; কিন্তু যাদের স্বার্থরক্ষার জন্য এই তথাকথিত বিভাজন— তারা কোনোভাবেই লাভবান হননি । 

error: Content is protected !!