ইতিহাস

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

Contents

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের ঘটনা বলে বিবেচনা করা যাবে না । বলা চলে এই দলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারত ইতিহাসের ভবিষ্যৎ এক নতুন ধারায় প্রবাহিত হবার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ হয়েছিল । জাতীয় কংগ্রেসের চরমপন্থী ও নরমপন্থী সদস্যগণ যখন নীতি নির্ধারণের প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে আপসহীন দ্বন্দ্বে লিপ্ত , তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতিসত্তার তত্ত্ব বেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে ।  

প্রসঙ্গত স্মরণীয় , মুসলিম শাসনকালে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট সম্প্রীতি বজায় ছিল । এমনকি মহাবিদ্রোহের কালেও হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে । কিন্তু ঘটনাচক্রে আর্থ-সামাজিক ( Socio-economic ) অবস্থাগত বৈষম্য এই দুই সম্প্রদায়কে পরস্পরের থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে দিতে থাকে । 

মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা 

এদেশে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজের সংস্রব ত্যাগ করে চলতে থাকে । মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য তারা একমাত্র ইংরেজকেই দায়ী করতে থাকে । তাদের এই ইংরেজ বিদ্বেষের পরিণতি ঘটে ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের সংগঠনে । এক্ষেত্রে মুসলিম সমাজ ইংরেজের বিরুদ্ধে ‘ সামগ্রিক যুদ্ধে’র অঙ্গীকার করে ।  

পরবর্তীকালে মহাবিদ্রোহের সময়েও মুসলিম সমাজ ব্যাপক সংখ্যায় বিদ্রোহীদের সাথে যোগদান করে । ব্রিটিশ সরকার সমস্ত আন্দোলনকেই দমন করে অস্বাভাবিক কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতা দ্বারা । স্বাভাবিকভাবেই এই দুই সম্প্রদায়ের মনে বিদ্বেষের ও অবিশ্বাসের আগুন জ্বলতে থাকে । ফলে মুসলমানরা ইংরেজের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । 

চতুর ইংরেজ সরকারও মুসলমানদের জব্দ করার জন্য হিন্দুদের প্রতি কিছুটা উদার নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে । শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত হিন্দুরা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপযোগিতা যথার্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় । পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হবার ফলে হিন্দুরা ক্রমশ উন্নতি করতে থাকে । অধিকাংশ সরকারিপদ হিন্দুদের করায়ত্ত হয় । পক্ষান্তরে , মুসলমানরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে । 

সৈয়দ আহমদের ভূমিকা 

স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করেন এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন । এই উদ্দেশ্যে তিনি আলীগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ সহ প্রতিষ্ঠা করেন বহু শিক্ষাসংস্থা । এই আলীগড় কলেজ থেকেই জন্মলাভ করে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ । চতুর ব্রিটিশ সরকারও ভারতবর্ষে তাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য বিচ্ছিন্নতাবোধকে মদত দিতে থাকে ।  

সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার কথা বললেও তা সম্ভব ছিল না । কারণ জাতীয় কংগ্রেসকে ‘ হিন্দু প্রতিষ্ঠান ’ আখ্যায় ভূষিত করে তিনিই মুসলমানদের মনে পাল্টা সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জুগিয়ে দিয়েছিলেন । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় লর্ড কার্জন সেই প্রেরণার মূলে জলসিঞ্চন করে তাকে পল্লবিত করে তুলতে চেষ্টা করেন । বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশ করার অব্যবহিত পূর্বে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরকালে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব প্রচার করেন । 

তিনি মুসলিম সমাজকে বোঝান যে , বাংলা ব্যবচ্ছেদ করলে মুসলমানদের প্রভূত উপকার হবে । ঢাকা পাবে রাজধানীর মর্যাদা । ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করতে শুরু করেন । তিনি ‘ মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন ‘ ( ১৯০৫ খ্রিঃ ) নামক একটি সংস্থা গঠন করে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত গঠন করতে উদ্যোগী হন । কৃষিজীবী সাধারণ মুসলমানগণ হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ জানানোর মাধ্যম হিসেবে কংগ্রেস প্রভাবিত স্বদেশি আন্দোলনের বিরুদ্ধে দলে দলে যোগ দিতে থাকে । 

সিমলা বৈঠক 

সংখ্যা গরিষ্ঠ কৃষিজীবী মুসলমানের এইরূপ মানসিক অবস্থার সুযোগে সলিমুল্লাহ প্রমুখ ব্যক্তি মুসলমানদের নিজস্ব একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠনে তৎপর হন । এই সময়ে একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল বড়োলাট লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায় । এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নেন আলীগড় কলেজের অধ্যক্ষ আর্চিবল্ড এবং সম্পাদক মহসিন উল মুলক ।  

আর্চিবল্ড বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলাদের সাথে সাক্ষাৎ করে কিংবা পত্র মারফত বোঝান যে , এই মুসলিম প্রতিনিধিদলকে গুরুত্ব দিলে ব্রিটিশ রাজের উপকার হবে । এর ফলে মুসলিম সমাজ যেমন ইংরেজের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে , তেমনি কংগ্রেসের গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পাবে । অবশেষে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১ লা অক্টোবর ৩৫ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল আগা খাঁ’র নেতৃত্বে লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সিমলায় সাক্ষাৎ করে । প্রতিনিধি দলের স্মারকপত্রে –

( ১ ) সামরিক ও বেসামরিক চাকুরিতে মুসলমানদের নিয়োগ , 

( ২ ) স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে মুসলমান প্রতিনিধি গ্রহণ , 

( ৩ ) বিভিন্ন আইন সভার মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা , 

( ৪ ) পৃথক মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি দাবি জানানো হয় । লর্ড মিন্টো এই দাবিগুলি সহানুভূতির সাথে বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দেন ।  

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সাক্ষাৎকার ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । কারণ লর্ড মিন্টো এই প্রতিনিধি দলকে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন । মিন্টোর প্রতিশ্রুতি পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানদের পৃথক সত্তার দাবিকে জোরদার করে । আগা খাঁ , সলিমুল্লাহ প্রমুখ কংগ্রেসের পাল্টা সংগঠন গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান । লর্ড মিন্টোর ভাষায় : “ এই সাক্ষাৎকার ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে । ” 

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা 

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘ মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন ‘ ( mohammedan education conference ) আহূত হয় । ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এর আমন্ত্রণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দ এতে যোগ দেন । এখানে সলিমুল্লাহ ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার দাবি জানান । সম্মেলনের সভাপতি বিখার – উল – মুলক ‘ মুসলিম লীগ ’ নামক একটি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন । এই প্রস্তাব গৃহীত হয় । মুসলিম লীগের প্রধান চারটি লক্ষ্যের কথা ঘোষাণা করা হয় । এগুলি হল— 

( ১ ) ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করা এবং সরকারের প্রতি সন্দেহের অবসান ঘটান । 

( ২ ) মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা ও সরকারের কাছে মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা পৌঁছে দেওয়া । 

( ৩ ) জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করা । 

( ৪ ) উপরোক্ত উদ্দেশ্যগুলি কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ।  

মুসলিম লীগ ঘোষণা করে ভারতের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক মৈত্রী সম্ভব কিন্তু রাজনৈতিক মৈত্রী কখনোই সম্ভব নয় । এইভাবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে ‘ মুসলিম লীগের ’ প্রতিষ্ঠা ঘটে ।

error: Content is protected !!