ইতিহাস

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের কারণ

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের কারণ

ভারতবর্ষে লর্ড কার্জনের শাসনকালের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা । শাসন ব্যবস্থার সুবিধা ও উন্নতির অজুহাতে তিনি বাংলাদেশকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা প্রকাশ করলে সারা দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব জাতীয় আন্দোলনের সূচনা ঘটে ।  

বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা 

ঊনবিংশ শতকের পাঁচের দশকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-অসম একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীনে ছিল । ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে অসমকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত করা হয় । কিন্তু উভয় প্রদেশেই শাসনতান্ত্রিক সমস্যা অব্যাহত থাকে । সেই সময় চট্টগ্রামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সাথে যুক্ত করার একটি প্রস্তাব উঠেছিল । কিন্তু নানা কারণে তা কার্যকরী হয়নি । 

মধ্যপ্রদেশের প্রশাসক থাকাকালীন এন্ড্র ফ্রেজার ও উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্যপ্রদেশের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন । এ প্রস্তাবও শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি । অতঃপর বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে যোগ দান করেই ফ্রেজার বঙ্গ বিভাগের বিষয়ে মনযোগী হন । তিনি অল্পদিনের মধ্যেই লর্ড কার্জনের কাছে বঙ্গভঙ্গের এক পরিকল্পনা পেশ করেন । 

প্রস্তাবে বলা হল , আসামের সঙ্গে ঢাকা , চট্টগ্রাম ও রাজশাহি জেলা যুক্ত করে ‘ পূর্ববঙ্গ ও আসাম ‘ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হোক । এই বিভাগ সম্পন্ন হলে শাসন ব্যবস্থার সুবিধা হবে এবং জেলাগুলির উন্নতি ঘটবে । কার্জন এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেন । ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি ভাবে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সমগ্র বাংলায় প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয় । বিভিন্ন জেলায় এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হতে থাকে । কিন্তু বঙ্গবাসীর সমস্ত রকম প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন । 

লর্ড কার্জনের আসল উদ্দেশ্য 

বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে কার্জনের আসল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক , শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনটা ছিল অজুহাত মাত্র । ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি তার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না । সাম্রাজ্যবাদী কার্জনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করা । তাই তিনি ‘ বিভাজন ও শাসন নীতি ‘ অনুসরণ করতে উদ্যোগী হন ।  

এদেশে এসেই বিচক্ষণ কার্জন বুঝেছিলেন যে , ভারতের জাতীয় আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ । পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি ইংরেজের সীমাহীন শোষণ যে বরদাস্ত করবে না , এ সত্য তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । বাঙালির দুর্বলতম স্থানটিও তাঁর অজ্ঞাত ছিল না । সমকালীন কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্তার বক্তব্য থেকে সরকারের এই ষড়যন্ত্রের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠে ।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায় যে হিন্দুদের ব্যাপারে কিছুটা স্পর্শকাতর হয়ে আছে , এ কথাও কার্জন জানতেন । তা ছাড়া সেই সময়ে বেশ কিছু মুসলিম নেতা ব্রিটিশ সরকারের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন । তাই ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলায় প্রতিবাদধ্বনি উচ্চারিত হয় । সঙ্গে সঙ্গে কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে বেড়িয়ে পড়েন ।  

এই সফরে তাঁর অন্যতম কাজ ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মনে হিন্দু বিদ্বেষের বীজ বপন করা । বাংলাদেশ বিভক্ত হলে মুসলমানরা যে লাভবান হবে , মুসলমানরা হিন্দু প্রভাব থেকে দূরে থেকে উন্নতি করতে পারবে — এ কথাও তিনি প্রচার করতে থাকলেন । একটা জিনিস স্পষ্ট হল যে , সুশাসনের প্রয়োজনে নয় , বাঙালির ঐক্য ও সংহতি নষ্ট করাই ছিল বঙ্গভঙ্গের আসল উদ্দেশ্য ।

error: Content is protected !!