ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা
Contents
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশে ব্রিটিশ শাসনের ফলে উদ্ভূত সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস বিশেষভাবে দায়ী ছিল । ব্রিটিশ শাসনে ভারতে যে নতুন সামাজিক , অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মিত হয় , তার ফলে ভারতের গ্রামীণ ও নাগরিক সমাজে সামাজিক বৈষম্য ও সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে । ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনের ফলে কৃষক ও জমিদারদের মাঝে একদল বৃত্তিধারী ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে ।
জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ
পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম দেয় । ভারতের প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা , কুসংস্কার ও ধর্মভীরুতা — এসবের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন তাদের বিদ্রোহী করে তোলে , অন্যদিকে তাদের মনে জন্ম দেয় প্রবল স্বদেশানুরাগের । ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি তথা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে ইংরেজ শাসকদের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল । মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ অনুরক্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনেই ইংরেজ বিরোধিতার সূচনা ঘটে । ইংরেজি শিক্ষার এই সৃজনী ভূমিকার জন্যই স্যার আলফ্রেড লয়াল ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকে— ‘ A story of grave political miscalculation ‘ বলে বর্ণনা করেছেন ।
বিদেশি শাসনে দেশের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস হতে শুরু করেছে । ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশীয় শিল্প বাণিজ্য ক্রমশ পিছু হটছে , কিন্তু এর প্রতিকারের পরিবর্তে ইংরেজ শাসককুল বাড়িয়ে যাচ্ছে শোষণের মাত্রা ; – এই চিন্তা ভাবনা মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কিছুটা বিচলিত করে তুলল । তবে বিদ্রোহ পূর্ববর্তী সময়ে মধ্যবিত্তদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন সভার পক্ষ থেকে কিছু কিছু দাবি উত্থিত হলেও ইংরেজদের সম্পর্কে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিশেষ বিচলিত ছিল না । তবে এদের কর্মক্ষেত্র যতই ব্রিটিশ ঘেঁষা হোক না কেন , এরা পথ কেটে না গেলে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাপকতর জাতীয় আন্দোলন কখনোই সম্ভব হত না ।
ব্রিটিশ শাসনের উপর মোহভঙ্গ
ঊনবিংশ শতকের ছয় এর দশক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তা ভাবনার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মোহভঙ্গ ঘটে । শিল্পোন্নত আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের রূপান্তরিত ইংরেজ শাসকরা ভারতকে আরও নিষ্করুণভাবে লুটের বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে ।
ব্রিটেনের শিল্প বিকাশের জন্য ভারত কাঁচামাল সরবরাহ করতে বাধ্য হয় । ইংরেজ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ভারতের আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়া হয় এবং ভারতীয় পণ্যদ্রব্যের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া হয় । এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ভারতের কুটির শিল্পের সর্বনাশ হল এবং ভারতবাসীর অর্থনৈতিক অবস্থা চরমে পৌছাল ।
১৮৬০-১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের ঋণভার ৯৪.৫৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১২ কোটি টাকায় । ফলে দুর্ভিক্ষ ও অনাহার হল ভারতবাসীর নিত্য সাথী । ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি দুরূহ অর্থনৈতিক আবর্তে নিমগ্ন হল । প্রশাসনিক ও সামরিক খাতে ব্যয়ভার মেটানোর জন্য জমির উপর খাজনার হার বৃদ্ধি করা গেল । ফলে কৃষক শ্রেণির অবস্থা হয়ে উঠল দুর্বিষহ । ফলে ভারতীয় ঐতিহ্যের দিকে মুখ ফেরানো এবং ইউরোপীয় সভ্যতার সবকিছু ভালো — এ মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে লাগল ।
ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা
ইংরেজের অন্ধ অনুকরণে দেশের মঙ্গল নেই , ভারতীয় শিল্প , সাহিত্য ও শক্তির বিকাশেই ভারতবর্ষের মঙ্গল — এই চিন্তাই জন্ম দিয়েছিল হিন্দুমেলার । কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দুমেলা বন্ধ হয়ে গেলেও তা দেশে বইয়ে দিয়েছিল জাতীয়তাবাদের নতুন স্রোত । শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে কয়েকজন তরুণ ব্রাহ্ম ১৮৭৬ এ অগ্নিসাক্ষী করে শপথ গ্রহণ করে যে , স্বায়ত্তশাসনই তাদের লক্ষ্য এবং বিদেশি শাসনের দাসত্বকে তারা কখনোই মেনে নেবেন না । এই জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ শুধু বাংলায় নয় , ভারতের বহু স্থানেই দেখা গিয়েছিল ।
সরকারি শোষণের প্রতিক্রিয়া
সরকারি শোষণ ও বৈষম্য ভারতবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করলেও ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ বা কল্যাণ সাধনের জন্য বিন্দুমাত্র সচেষ্ট হলেন না । পরন্তু দেশবাসীর মুখ বন্ধ করতে চাপিয়ে দিলেন একাধিক দমন মূলক আইন । লর্ড লিটনের শাসনকালে ব্রিটিশ শোষণের চিত্রটি প্রকট হয়ে ওঠে । ‘ দেশীয় সংবাদপত্র আইন ‘ , ‘ অস্ত্র আইন ‘ , ‘ শুল্ক আইন ‘ প্রভৃতি প্রয়োগ করে তিনি ভারতবর্ষকে শক্তি ও সামর্থ্য উভয় দিক থেকে পঙ্গু করতে উদ্যোগী হলেন ।
ভারত সভার প্রতিষ্ঠা
অবশ্য ভারতবাসীও জাতীয় আন্দোলন সংগঠনে পিছিয়ে ছিলেন না । ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছে ভারতবাসীর সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থা ‘ ভারত সভা ’ । এর প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সিভিল সার্ভিস সংক্রান্ত আন্দোলন । সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার গভীর ষড়যন্ত্রমূলক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়সসীমা ১৯ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন । উদ্দেশ্য ছিল যাতে অধিকসংখ্যক ভারতবাসী এই পরীক্ষায় বসতে না পারে এবং শাসনকর্মে অধিক সংখ্যায় অংশ নিতে না পারে । ভারত সভা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে ।
এমনকি ইংল্যান্ডে পার্লামেন্টে বক্তব্য রাখার জন্য ব্যারিস্টার লালমোহন ঘোষকে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করে ৷ শুধু তাই নয় , দেশীয় সংবাদপত্র আইন বা আসাম ও উত্তরবঙ্গের চা বাগানের কুলিদের উপর সাহেবদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধেও ভারত সভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে । রচিত হয় ‘ কুলি কাহিনি ’ , – যা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে চা বাগানের সাহেবদের নিষ্ঠুর ও ব্যভিচারী কীর্তিকাহিনি এবং সৃষ্টি করে গভীর ইংরেজ বিদ্বেষের ।
দেশীয় পত্র পত্রিকার অবদান
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার , ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় জাগরণ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে দেশীয় পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের বিশেষ অবদান ছিল । দীববন্ধু মিত্রের ‘ নীলদর্পণ ’ , বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ আনন্দমঠ ’ , ‘ দেবী চৌধুরানি ‘ , বিবেকানন্দের ‘ বর্তমান ভারত ’, রমেশচন্দ্রের ‘ জীবন প্রভাত ‘ , রবীন্দ্রনাথের ‘ মুক্তধারা’ও ‘ অচলায়তন ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
বহির্বঙ্গের লেখকদের মধ্যে বেজ বড়ুয়া , ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র , মধুসূদন রাও , সুব্রহ্মণ্য ভারতী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য । জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা সমন্বিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে ‘ সংবাদ প্রভাকর ’ , ‘ বেঙ্গলী সঞ্জীবনী ’ , ‘ বঙ্গবাসী ’ প্রভৃতির নাম স্মরণীয় । বাংলার বাইরে প্রকাশিত এই জাতীয় পত্রপত্রিকার মধ্যে ‘ ট্রিবিউন ’ , ‘ ভয়েস অব ইন্ডিয়া ’ , ‘ হিন্দু’ , ‘ মারাঠা ’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
ইলবার্ট বিল আন্দোলনের শিক্ষা
ইলবার্ট বিলকে ( ১৮৮৩ খ্রিঃ ) কেন্দ্র করে শ্বেতাঙ্গদের আন্দোলন ভারতবাসীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় । এই বিলে ভারতীয় বিচারকদের শ্বেতাঙ্গদের বিচারের অধিকার দেওয়া হয় এবং জঘন্য বৈষম্যমূলক প্রথার অবসান ঘটানো হয় । কিন্তু ইউরোপীয় মহলে এই বিল তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং এর তীব্র বিরোধিতা করে । এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য গঠিত হয় ইউরোপীয়দের অধিকার রক্ষা সমিতি ।
শিক্ষিত ভারতবাসী বুঝতে পারেন বর্ণ বৈষম্য বোধ ক্ষুদ্র ইউরোপীয় সম্প্রদায়কে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছেন । ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে পক্ষে ও বিপক্ষে যে তুমূল আন্দোলন হয় , তাতে এদেশের জাতীয়তাবাদীদের পুনর্জাগরণ ঘটে । এই নবচেতনা থেকেই জন্ম নেয় একটি জাতীয় সম্মেলন সংগঠিত করার উৎসাহ ।
১৯৮৩ ডিসেম্বরে সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহন বসুর উদ্যোগে কলকাতায় প্রথম জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয় । প্রায় সারা ভারতের ও সব ধর্মের মানুষ এতে যোগদান করেন । এই সভায় দায়িত্বশীল প্রতিনিধিমূলক শাসন ব্যবস্থা , অস্ত্র আইনের দাবি করা হয় । এখানে জাতীয় আন্দোলন চালানোর জন্য একটি ধনভাণ্ডার গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয় ।
এই সম্মেলন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করে । সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে কলকাতাতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে । একই সময়ে বোম্বাই -তে বসে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন । অতঃপর সম্মেলন ও কংগ্রেস মিলিতভাবে জাতীয় আন্দোলনের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে ।