ইতিহাস

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি

Contents

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি

ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে বিশেষত ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী কালে ভারতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের নগ্নচরিত্রটি পরষ্কার হয়ে ওঠে । ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শোষণ ও শাসনতান্ত্রিক দমননীতির পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে । ব্রিটিশ শাসকগণ কর্তৃক অনুসৃত উগ্র বর্ণবিদ্বেষ শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকে । জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি সম্পর্কে বিতর্ক আছে । 

( ১ ) অনেকে মনে করেন যে , ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে আয়োজিত ‘ দিল্লি দরবার ’ এ সমবেত ভারতীয় প্রতিনিধিরা এই সর্বভারতীয় সংস্থা গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন । 

( ২ ) লালা লাজপত রায়-এর মতে , তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডাফরিন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা । Young India পত্রিকায় তিনি লিখেছেন , “ Congress was a product of Dufferin’s brain . ” 

( ৩ ) অ্যানি বেসান্ত দাবি করেছেন যে , জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব থিওজফিস্টদের প্রাপ্য । ১৮৮৪ -তে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে থিওজফিস্টরা এরকম একটি সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন । তবে এই মতগুলি যথেষ্ট যুক্তি বা তথ্য দ্বারা সমর্থিত হয়নি । 

অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের ভূমিকা 

জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্য একটি দিকও ছিল । অপেক্ষাকৃত উদার ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কিছু ইংরেজ আমলা ভারতের বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ বোধ করছিলেন । তারা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে , শুধু দমন পীড়নের পথ গ্রহণ করলে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আরও বেশি করে মুখ ফেরাবেন কৃষক সমাজ ও শ্রমজীবী মানুষের দিকে ।  

সমগ্র ভারতবাসী জাগ্রত ও সংঘবদ্ধ হলে ভারতে ইংরেজ শাসনের পতন অবশ্যম্ভাবী হবে । তাই ইংরেজদের উচিত হবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসন সংস্কারের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা ও ভারতবাসীর মনে এই আস্থা এনে দেওয়া যে , ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সংগ্রাম করে নয় , সহযোগিতার পথেই ভারতবাসীর দাবি বাস্তব রূপ পেতে পারবে ।  

এই অবস্থায় অবসারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ভারতবাসীর সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনা করেন । জাতীয় কংগ্রেসের আদিপর্বের ইংরেজ সভাপতি ওয়েডার বার্ন ( W. Burn ) ‘ Father of Indian National Congress ‘ গ্রন্থে লিখেছেন , “ লর্ড লিটনের বড়োলাট থাকার শেষ দিকে হিউম এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে , ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতেই হবে । ”  

হিউমের খোলা চিঠি 

সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে হিউম ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১ লা মার্চ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক উদ্দেশ্যের একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন । এই চিঠিতে তিনি দেশের উন্নতি বিধানে শিক্ষিত সমাজের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন । পরিশেষে দেশের রাজনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী সংগঠন গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান ।  

অতঃপর তিনি ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তার পরিকল্পনার কথা ডাফরিনকে জানান । এমনকি এই উদ্দেশ্যে হিউম ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানকার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সমর্থন লাভ করেন । ইতিমধ্যে তিনি ‘ ভারতীয় জাতীয় ইউনিয়ন ‘ নামে একটি সংস্থা গঠন করেছেন ।  

পরিশেষে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে পুনা শহরে তিনি পরিকল্পিত কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করেন । তিনি জাতীয় ইউনিয়নের সদস্যগণকে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক সংস্থাগুলিকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিতে আহ্বান জানান । কিন্তু পুনরায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় কংগ্রেসের অধিবেশনস্থল বোম্বাইতে স্থানান্তরিত করা হয় । 

সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের অবদান 

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্স ‘ নামে একটি জাতীয় মহাসভা আহ্বান করেন । দেশের বিভিন্ন অংশের বহু প্রতিনিধি এতে যোগদান করেন । জাতীয় আন্দোলনের ব্যয় সংকুলান এর জন্য এই সম্মেলনে একটি জাতীয় তহবিলও গড়ে তোলা হয় । এইভাবে সুরেন্দ্রনাথ অদম্য উৎসাহ ও প্রচেষ্টার দ্বারা ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করে বৃহত্তর জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের পটভূমিকা তৈরি করে দেন ।  

অবশেষে হিউমের কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথকে আহ্বান করা হয় এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স কংগ্রেসের সাথে মিশে যায় । এইভাবে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে শান্তিপূর্ণ ও আড়ম্বরহীন ভাবে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয় । 

নিরাপত্তা নিয়ামক 

কোনো কোনো সমালোচকের মতে , হিউম সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টি ভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়ে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন । এঁদের মতে , “ কংগ্রেস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপাতিত্বের সৃষ্টি এবং একটি গোপন ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি । ” 

রজনী পাম দত্ত মনে করেন , প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ ও পরিকল্পনার ফসল হিসেবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ভাইসরয়ের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রের ফসল এই সংস্থা গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়ী করা এবং এই সংগঠনকে এদেশে ইংরেজ শাসনের নিরাপত্তার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা ।

অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেসকে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে এক ‘ নিরাপদ নিয়ামক ‘ হিসেবে গঠন করা হয়েছিল । ওয়েডার বার্ন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন , “ আমাদের ভ্রান্ত নীতির ফলে যে ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ জমা হচ্ছিল , তা নিরাপদ খাতে প্রবাহিত করার জন্য একটি Safety Valve এর প্রয়োজন ছিল । সেদিক থেকে সর্বোৎকৃষ্ট সংস্থা হল নবজাত কংগ্রেস । ”  

বিরুদ্ধ মত 

আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে , কোনো-না-কোনো ভাবে ব্রিটিশ শাসনকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে হিউম কংগ্রেসের পরিকল্পনা করেছিলেন । তবে এ কাজে প্রত্যক্ষ সরকারি মদত ছিল কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ । কারণ হিউমের সাথে ডাফরিনের সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না । তা ছাড়া প্রথম থেকেই কংগ্রেসের গঠনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে ডাফরিনের সন্দেহ ছিল । তিনি কংগ্রেস সম্পর্কে অবজ্ঞা ভরে মন্তব্য করেন যে , এটি বাবু শ্রেণির সংগঠন , বালক সুলভ সংস্থা ইত্যাদি । 

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের এক ভোজ সভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি কংগ্রেস নেতাদের “ অণুবীক্ষণ দৃষ্ট সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি ” বলে ব্যঙ্গ করেন । এমনকি কংগ্রেসের অস্তিত্বের অবসান কামনা করে তিনি বলেন যে , “ We cannot allow the congress to continue to exist . ” ব্যক্তিগতভাবে হিউমকেও তিনি নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যক্তিত্ব বলে মনে করতেন না । ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডাফরিন হিউমকে ‘ ধূর্ত , বিকৃত মস্তিষ্ক , অহং সর্বস্ব ও সত্যের প্রতি উদাসীন ’ বলে সমালোচনা করেন । কংগ্রেস গঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি ইংরেজের হীন স্বার্থসিদ্ধি করা হত , তাহলে তিনি এ মন্তব্য করতেন না ।

সম্মিলিত প্রয়াসের ফল

বস্তুত জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সমস্ত কৃতিত্ব হিউমকে দেওয়াও বোধ হয় ঠিক নয় । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অনিল শীল , অমলেশ ত্রিপাঠি প্রমুখ মনে করেন , কংগ্রেসের জন্ম কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় । এর জন্য একটা দীর্ঘ পটভূমি দরকার ছিল । সেই পটভূমি তৈরির কাজে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিল না ।  

হিউম না থাকলেও একটা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন তখনই জন্ম নিত , তবে হয়তো তার নাম হত স্বতন্ত্র । হিউম এই সংগঠনের উদ্ভাবক হিসেবে পূর্ণ কৃতিত্ব পাওয়ার জন্যই কলিকাতার পরিবর্তে বোম্বাইতে কংগ্রেসের অধিবেশন ডাকেন । অথচ বাংলাদেশ , বিশেষত কলিকাতাই ছিল ভারতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র । যাই হোক , সুরেন্দ্রনাথ জাতীয় কংগ্রেসের আহ্বানকে গ্রহণ করে জাতীয় সম্মেলনের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না রেখে কংগ্রেসের সাথে মিশে যান ।

error: Content is protected !!