স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কার

Contents

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কার 

বিবেকানন্দের আসল নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত । সিমলার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম । কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং দর্শনশাস্ত্রের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন । তিনি হার্বার্ট স্পেন্সার , জন স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখের আদর্শ দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হন । কিছুদিনের জন্য তিনি ব্রাহ্মসমাজেও যোগ দেন । কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্বের বাহুল্য ও সমাজ সংস্কারের শুধুমাত্র মৌখিক প্রচার তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি । 

তিনি বুঝতে পারেন যে , কেবল তাত্ত্বিক প্রচার ভারতবর্ষের গোঁড়ামি , অজ্ঞতা ও দারিদ্র্য দূর করতে পারবে না । সত্য সন্ধানে আকুল হয়ে তিনি কলেজেরই অধ্যাপক মি. হেস্টীর নিকট ধর্মতত্ত্বের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চান । মি. হেস্টী নরেন্দ্রনাথকে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণের সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন ।  

এইভাবে ঘটে মহামিলন । বস্তু খুঁজে পায় আধার । ঘটে তার পরিপূর্ণতা । রামকৃষ্ণের অদ্বৈতবাদ , বেদান্তবাদ ও সমন্বয়বাদ নরেন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে । রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পরে তাঁর নাম হয় স্বামী বিবেকানন্দ । গুরুর দেহাবসানের পর তাঁর বাণী ও আদর্শ প্রচারের জন্য বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ‘ রামকৃষ্ণ মিশন ’ । জীবসেবা ও ধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন । 

স্বামী বিবেকানন্দের সর্ব সমন্বয় ভাবনা

বিবেকানন্দ ধর্ম চিন্তাকে নিছক ঈশ্বর উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি । রাজনীতি , সমাজনীতি ও ধর্মনীতি তাঁর কাছে একাকার হয়ে যায় । ভারতবাসীর দুঃখ বেদনা ও অভাব অভিযোগকে তিনি উপলব্ধি করেন নিজের অন্তর দিয়ে । রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাসীর বেশে সারা ভারত পরিভ্রমণ করেন ।   

ভারতের পরাধীনতা , সাধারণ ভারতবাসীর অশিক্ষা ও দারিদ্র্যতা তাঁকে ব্যথিত করে । তিনি বুঝতে পারেন , বিচ্ছিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে এই জাতীয় সমাধান সম্ভব নয় । তিনি বেদান্তের নতুন ব্যাখ্যা করেন এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহচর্যে ভারতবাসীকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন । আত্মবিশ্বাসকে তিনি মুক্তির প্রথম ও প্রধান সোপান হিসেবে বর্ণনা করেন । 

শিকাগো ধর্ম সম্মেলন 

সন্ন্যাসী আমেরিকার শিকাগো শহরে আহূত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে বেদান্তের মহিমা ও বিশ্বজনীনতার আদর্শ প্রচার করে হিন্দুধর্মকে জগৎসভায় পরিচিত করিয়ে দেন । হিন্দুধর্মের ত্যাগ , ধৈর্য , সহিষ্ণুতা , ক্ষমা ও সেবার আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বহু বিদেশি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও ঐশ্বর্যের প্রাবল্য দেখে তিনি আক্ষেপ করে বলেন , “ পাশ্চাত্যের এই ঐশ্বর্যের পাশে হায় আমার দরিদ্র ভারতভূমি তুমি কোথায় ! ”  

সমাজবাদ

ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত পদব্রজে পরিভ্রমণ করে মুক্তির বাণী প্রচার করেন । এই মুক্তি ছিল পরাধীনতার থেকে , আর্থিক শোষণ থেকে , সামাজিক বিভেদ থেকে মুক্তি ; রাজনীতি , সমাজনীতি , অর্থনীতি , ধর্মনীতি — জীবনের প্রত্যেকটি দিক সম্পর্কেই তিনি দেশবাসীকে সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট হন । 

ব্রাহ্মণ শ্রেণীর ধর্মীয় একাধিপত্য , শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি , অস্পৃশ্যতা , রাজনৈতিক ভণ্ডামি প্রভৃতি সবকিছুকেই তিনি তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণ করে ভারতবাসীকে ‘ আত্মবলে ’ বলীয়ান হতে উদ্বুদ্ধ করেন । তিনি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ ভারত গঠনের সম্ভাবনা দেখেন । তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে , “ শূদ্র যুগ আসছে । তিনি বিনা দ্বিধায় নিজেকে একজন সমাজতন্ত্রী বলে অভিহিত করেন । ” সমাজবাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন , “ All other systems have been tried , let this one be tried ….. Because half is better than no bread . ” মানুষের মঙ্গল সাধনে উপযুক্ত যে কোনো মতবাদকেই গ্রহণ করতে তিনি প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেন । 

জাতীয়তাবাদ

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ লালিত হয়েছে বিবেকানন্দের মাধ্যমে । তিনি দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করে তার মুক্তির জন্য সবাইকে আত্মোৎসর্গের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে বলেন । “ বর্তমান ভারত ” গ্রন্থে তিনি বলেন , “ হে ভারত ভুলিও না তুমি জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত । ” তাঁর তেজোদীপ্ত বাণী ভারতীয় বিপ্লবীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে । তাই ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার স্বামী বিবেকানন্দকে ‘ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক ‘ বলে অভিহিত করেছেন । 

স্বামী বিবেকানন্দের জীব সেবা  

বাস্তববাদী বিবেকানন্দ মোক্ষ লাভের জন্য কখনও সমাজ সংস্কার ত্যাগ করেননি । ঈশ্বরকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন দীন দুঃখী সাধারণ মানুষের মধ্যে । গুরুর শিক্ষানুযায়ী জীব সেবাকেই তিনি ঈশ্বর সেবার প্রথম ও প্রধান সোপান বলে গ্রহণ করে ” জীবে প্রেম করে যেই জনসেই জন সেবিছে ঈশ্বর ” —এই বক্তব্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন রামকৃষ্ণ মিশন । আজও এই সংস্থার সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা জীবসেবার কাজে সর্বদা নিয়োজিত ।

error: Content is protected !!