শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়
Contents
শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়
বাংলা তথা ভারতের ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ( ১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রিঃ )। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন লোকশিক্ষক । সহজ সরল ভাষায় কথিত শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর মর্মার্থ স্বামী বিবেকানন্দের মাধ্যমে জীব ও জগতের মঙ্গলে কার্যকর হয় । ভারতের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একটি অবিস্মরণীয় নাম ।
এক যুগ সন্ধিক্ষণের মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল । তখন একদিকে ছিল নব যুক্তিবাদের আলোকে শিক্ষিত যুবাদল কর্তৃক যুক্তি ও বিচারের মাধ্যমে ধর্মকে গ্রহণ করার চেষ্টা করা , আর অন্যদিকে ছিল ঐতিহ্যবাদের উপর ভিত্তি করে সনাতন পন্থাকে জীইয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা । নতুন ও পুরাতনের এই দ্বন্দ্বের মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক । তিনি কোনো মতকেই অন্ধভাবে গ্রহণ করেননি , আবার কোনো মতকেই সম্পূর্ণ অস্বীকারও করেননি । তিনি পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন , কিন্তু বেদের নিরাকার উপাসনা পদ্ধতিতেও অস্বীকার করেননি । কোনো নির্দিষ্ট ধর্মপদ্ধতিতে তাঁর হৃদয়ের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেনি ।
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখা যেমন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল , তেমনি ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের বক্তব্যও তাঁকে অভিভূত করেছিল । তিনি বলতেন , ‘ যত মত তত পথ । ” তাঁর সমন্বয়ী প্রতিভা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. পি. মজুমদার বলেছেন , “ তিনি ( রামকৃষ্ণ ) শৈব নন , শাক্ত নন , বৈষ্ণব নন , এমনকি কট্টর বেদান্তবাদীও নন । তবু তাঁর মধ্যে আছে এইসব মতবাদের সংমিশ্রণ । ”
শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যজীবন
হুগলি জেলার অন্তর্গত কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন ( ১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রিঃ ) । তাঁর আসল নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায় । বাল্যকাল্যেই তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরোহিত নিযুক্ত হন । এখানেই তিনি দিব্য সাধনায় লিপ্ত হন এবং সিদ্ধিলাভ করেন । তোতাপুরী নামক বৈদান্তিক সাধুর কাছে তিনি দীক্ষা নেন । তোতাপুরী তাঁর নতুন নামকরণ করেন ‘ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ’ ।
সমন্বয়ের অগ্রদূত
আক্ষরিক অর্থে রামকৃষ্ণ শিক্ষিত ছিলেন না । স্কুল কলেজের পুঁথিগত শিক্ষা তাঁর কিছুই ছিল না । কিন্তু তাঁর ছিল গভীর আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা । সহজ সরল এবং কথ্য ভাষায় তিনি যেসব বাণী প্রচার করে গেছেন , তা আজও নতুন নতুন ভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে । তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ছিল সহজ অথচ গভীর অর্থবাহী । তিনি বলতেন “ ঈশ্বর এক এবং অভিন্ন । আল্লা , হরি , খ্রিস্ট সবই এক । ” যার যেভাবে খুশি ডাকে । তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন , যেমন ওয়াটার ( water ) , পানি , জল — যে যেভাবেই বলুক পদার্থটা এক ।
হিন্দুধর্মের সাকার-নিরাকার উপাসনার পদ্ধতির বিরোধও তিনি মিটিয়ে দেন । তিনি বলেন , যিনি সাকার তিনিই নিরাকার । মূর্তি পূজা নিন্দনীয় নয় , আবার নিরাকার উপাসনাও শাস্ত্র সম্মত । তাঁর এই সমন্বয়ী আদর্শ হিন্দুধর্মের অন্তর্বিরোধ অনেকখানি প্রশমিত করে । তিনি জাতিভেদ স্বীকার করেননি । হিন্দুধর্মে প্রচলিত কুসংস্কার ও আড়ম্বর সর্বস্বতাকেও তিনি অস্বীকার করেছেন । তাঁর মতে , “ যত্র জীব , তত্র শিব । ” অর্থাৎ জীবই শিব । তার কাছে মানুষের সেবা ও ঈশ্বরের আরাধনা ছিল সমার্থক । নারী জাতির মুক্তি ও দরিদ্রের ক্লেশ লাঘবের কথা তিনি আন্তরিকভাবে চিন্তা করতেন ।
শিষ্য মন্ডলী
রামকৃষ্ণের জ্ঞান ও ভক্তির আকর্ষণে বহু ব্যক্তি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । এঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন স্বামী বিবেকানন্দ । এ ছাড়া মহেন্দ্রনাথ ( শ্রীম ) , নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বহু গুণী ব্যক্তি শ্রীরামকৃষ্ণের জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন । তার বহুমুখী অবদানের কথা স্মরণ করে ড. আর. সি. মজুমদার লিখেছেন , “ প্রায় তিন সহস্র বৎসরব্যাপী ভারত আধাত্ম্যজগতে যে অগ্রগতি লাভ করেছে , তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ । ”