ইতিহাস

নব্যবঙ্গ আন্দোলন

Contents

নব্যবঙ্গ আন্দোলন 

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ একদল যুবক ঊনবিংশ শতকে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন , তা ‘ নব্যবঙ্গ আন্দোলন ‘ বা ‘ ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন ‘ নামে পরিচিতি লাভ করেছে । পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের উগ্র-পরিবর্তনকামী মনোভাব গড়ে তুলেছিল । পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শনের সংস্পর্শে এসে এই যুব সম্প্রদায় ভারতবর্ষের বিশেষত হিন্দুধর্মের প্রচলিত সমস্ত রীতিনীতিকে অসার ও অবাস্তব বলে মনে করতে শুরু করে ।  

রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যখন একদল শিক্ষিত মানুষ এদেশের ঐতিহ্যকে স্মরণে রেখে সংস্কারের মাধ্যমে তার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন , তখন একদল শিক্ষিত যুবক এদেশের ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । এই যুবকদল প্রচলিত সকল প্রকার ধর্মীয় রীতিনীতি ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানকে নস্যাৎ করে দিয়ে তাকে নতুন করে গড়ে তোলার তত্ত্ব প্রচার করেন ।  

নৈরাজ্যবাদীদের মতো নব্যবঙ্গ দল দেশের সবকিছুকেই সমালোচনা করতে শুরু করেন । ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল এঁদের আক্রমণের লক্ষ্য । ভারতের সবকিছুকেই এঁরা তীব্র ভাষায় নিন্দা করতে শুরু করেন । এঁদের বিশ্বাস ছিল যে , পুরাতন যা অসার , যা অবাস্তব তাকে সম্পূর্ণভাবে উৎপাটিত না করলে নতুনের বা বাস্তবের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না । এই কারণে অনেকে এঁদের ‘ চরমপন্থী ‘ বলে অভিহিত করেন । 

নববঙ্গ আন্দোলনে ডিরোজিওর ভূমিকা

নব্যবঙ্গ ‘ নামে খ্যাত যুবাদলের প্রাণপুরুষ ছিলেন হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও ( ১৮০৯-১৮৩১ খ্রিঃ ) নামক প্রতিভাবান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিক্ষক । মাত্র সতেরো বৎসর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন । ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনা কার্যে নিযুক্ত ছিলেন । শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সফল । তাঁর প্রেরণার উৎস ছিল ফরাসি বিপ্লব । 

জাতীয়তাবাদী এই আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডিরোজিও আধুনিকতম ও প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার পরিপোষণ শুরু করেন । টমাস , পেইন , হিউম প্রমুখের যুক্তিবাদী দর্শন তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে । অল্পদিনের মধ্যেই তিনি কবি , সুলেখক , দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ্ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । নিজে বয়সে তরুণ হলেও তিনি একদল তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রের বিশেষ অনুরাগ ও আনুগত্যের অধিকারী হতে পেরেছিলেন । মাত্র তেইশ বৎসর বয়সে এই প্রতিভাবান তরুণের মৃত্যু হয় ।

স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদে বিশ্বাসী ডিরোজিও তাঁর অনুগামী ছাত্রদের কোনো কিছুই বিনা বিচারে গ্রহণ বা স্বীকার করতে নিষেধ করতেন । তিনি বলতেন , “ স্বাধীন চিন্তার দ্বারা মত ও পথ স্থির করিবে ,কোন প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুসরণ করিবে না, জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করিবে , সকল প্রকার সৎগুণ অনুশীলন করিবে , এবং যাহা কিছু অন্যায় ও অসৎ তাহা পরিহার করিবে । ” তাঁর অনুগামীরা যাতে নীচতা ও নৈতিক স্খলন দোষে পতিত না হয় , এ বিষয়ে তিনি সর্বদা তাদের সতর্ক করে দিতেন ।  

ডিরোজিওর শিষ্যগণ পচনশীল প্রাচীন প্রথা সমূহ , রীতিনীতি ও সংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন । নারী জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোও নব্যবঙ্গ দলের অন্যতম কর্মসূচি ছিল । অধ্যাপক বিপিনচন্দ্র ডিরোজিওকে ‘ আধুনিক ভারতবর্ষের প্রথম জাতীয়বাদী কবি‘ বলে অভিহিত করেছেন । তাঁর মতে , ডিরোজিও এবং নব্যবঙ্গ নামে পরিচিত তাঁর অনুগামীরা গভীর স্বদেশ প্রেমে আপ্লুত ছিলেন । 

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা

ডিরোজিও তাঁর অনুগামী ছাত্রদের নিয়ে ‘ অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন‘ ( Academic Association ) নামে একটি সমিতি গঠন করেছিলেন ( ১৮২৮ খ্রিঃ ) । এই সমিতিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক হত । তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রামতনু লাহিড়ী , রসিক কৃষ্ণ মল্লিক , দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় , রাধানাথ শিকদার , শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ । 

উগ্র সংস্কারকামী প্রবণতায় এঁদের ব্যবহার ও কথাবার্তায় উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার প্রাধান্য দেখা যায় । এঁদের বাণী ছিল “ হিন্দুধর্ম নিপাত যাক , কুসংস্কার নিপাত যাক । ” ব্রাহ্মণদের উত্তেজিত করার জন্য এঁরা চিৎকার করে ঘোষণা করতেন , “ আমরা গোরু খাই গো , আমরা গোরু খাই । ” কেউ কেউ প্রকাশ্যে পৈতা ছিঁড়ে পদদলিত করতেন ।  মাধবচন্দ্র মল্লিক কলেজ পত্রিকায় লেখেন : “ If there is anything that we hate from the bottom of our heart it is Hinduism । ”  

রসিক কৃষ্ণ মল্লিক ঘোষণা করেন , “ গঙ্গার পবিত্রতায় তাঁদে বিশ্বাস নেই ” ইত্যাদি । এই অতি উচ্ছ্বাস হিন্দুদের মনে যুগপৎ ক্ষোভ ও আতঙ্কে সঞ্চার করে । কলকাতার প্রভাবশালী হিন্দু নেতাদের চাপে ডিরোজিও হিন্দু কলেজ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । এর অল্পকাল মধ্যেই তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে । 

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের অবদান

আপাতদৃষ্টিতে ‘নব্যবঙ্গ ’ যুবকদের নৈরাশ্যবাদী ও ভাঙনধর্মী মনে হলেও , এটিই তাঁদের সম্পর্কে শেষ কথা হতে পারে না । ডিরোজিও ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী রোমান্টিক সংস্কারক । হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি , অমানবিক আচার অনুষ্ঠান , অযৌক্তিক অবাস্তব চিন্তাভাবনা তাঁর হৃদয়কে ব্যথিত করেছিল । তাঁর আহ্বানে শিক্ষিত যুবকদল হয়তো কিছুটা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন , কিন্তু ভারতের সমাজ ব্যবস্থা তাঁদের কাছে কম ঋণী নয় । এই উগ্র ছাত্র মন্ডলীর অধিকাংশই ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান । কর্মজীবনে এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই সংস্কারক ও সমাজসেবীতে পরিণত হয়েছিলেন ।  

প্রচলিত বিধি ব্যবস্থার ধ্বংস কামনার পাশাপাশি এঁরা গঠনমূলক কাজও করে গিয়েছিলেন । জাতিগঠনের বিভিন্ন কাজে এঁরা আত্মনিয়োগ করেন । কালক্রমে এঁরা পরিণত বুদ্ধি জাতীয়তাবাদীতে পরিণত হন । এঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলির মধ্যে ‘ জ্ঞানান্বেষণ ’ , ‘ একোয়ারার ’ ( Enquirer ) , ‘ বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ , ‘ হিন্দু পাইওনিয়ার’ প্রভৃতি দেশবাসীর মনে যুক্তিবাদ বিস্তার এবং কুসংস্কার মুক্ত মানসিকতা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল । বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার উদ্দেশ্যে এঁরা ‘জ্ঞান আহরণী সমিতি ‘ ( Society for the Acquisition of General Knowledge ) প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৩৮ খ্রিঃ ) ।  

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অর্জন , মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা , নারী শিক্ষা প্রসার , পাঠাগার স্থাপন প্রভৃতি বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গে এঁরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন । এককথায় , বাংলা তথা ভারতের ভাব জগতের পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে নব্যবঙ্গ সদস্যদের অবদান উল্লেখযোগ্য । 

ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ত্রুটি নব্যবঙ্গ আন্দোলনকে দুর্বল করে তুলেছিল ।  

প্রথমত , নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ধারক এবং বাহক ছিলেন শহুরে অভিজাতগণ । দেশের সাধারণ মানুষের সাথে এঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না । এঁদের বক্তব্য প্রচারিত হত কেবল ছাপানো পুস্তিকার মাধ্যমে । ফলে এর প্রসার ছিল কেবল শহুরে এবং শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে ।  

দ্বিতীয়ত , দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রেণির উন্নতির প্রতি এঁদের কোনো আগ্রহ ছিল না । অথচ জনসংখ্যার মূল অংশ ছিল এরাই । কৃষি উন্নয়নমূলক চিন্তাভাবনা বর্জিত হবার ফলে কৃষককুল এই আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিষ্পৃহ হয়ে পড়ে ।  

তৃতীয়ত , হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভ বুদ্ধি জাগ্রত না করে , তাকে আক্রমণ করার ফলে পুরো সম্প্রদায়ই নব্যবঙ্গদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল । 

চতুর্থত , এঁদের প্রগতিশীল ধ্যানধারণা গ্রহণ করার মতো সামাজিক পরিবেশ তখনো গড়ে ওঠেনি । তাই সৎ এবং প্রয়োজনীয় হলেও এঁদের বক্তব্য ব্যাপক জনসমর্থন লাভে বঞ্চিত হয়েছিল ।  

উপরোক্ত ত্রুটি সত্ত্বেও ভারতীয় চেতনার উন্মেষ নব্যবঙ্গ আন্দোলনের অবদান স্মরণীয় । এদের আন্দোলন এবং কঠোর সমালোচনা রক্ষণশীল হিন্দু সমাজকে যথেষ্ট নাড়া দেয় এবং সংস্কারের আবশ্যিকতা বুঝিয়ে দেয় । তাই জাতীয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন , “ এঁরাই বাংলায় আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক । এঁরাই আমাদের জাতির পিতা , এঁদের গুণাবলী চিরস্মরণীয় । এঁদের দুর্বলতা বা দোষ ত্রুটি সম্বন্ধে মুখর হয়ে ওঠা উচিত হবে না । ”

error: Content is protected !!