ইতিহাস

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব

Contents

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব 

ঊনবিংশ শতকে ভারত ভূমিতে আবির্ভূত মহান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । আধুনিক বাঙালির জীবনেও তাঁর প্রভাব অপরিসীম । তিনি ছিলেন বহুগুণ সম্পন্ন ব্যক্তি । তীক্ষ্ণ মেধা ও দুর্জয় সাহসকে ভর করে তিনি ভেঙে চুরমার করে দিতে চেয়েছেন সমাজ জীবনের অন্ধকার দিকগুলিকে । তাঁর সমগ্র জীবন ব্যয়িত হয়েছে স্বদেশবাসীর সার্বিক উন্নয়নের কাজে । কোনো অন্যায়ের সাথেই তার আপস ছিল না । বিদ্যাসাগরের চরিত্রের এহেন অনমনীয় দৃঢ়তা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : “ আমাদের এই অবনমিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতে এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল । ”  

১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম হয় । পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী উভয়েই তাঁর চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন । পিতামাতার কাছ থেকে তিনি সরলতা ও দ্রয়ার্দ্রতা গুণ লাভ করেন । কঠোর সংগ্রামের দ্বারা তিনি শিক্ষালাভ করেন । ১৮৫১ খিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন । সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ছিল । কিন্তু এই শিক্ষা কখনো তাঁর দৃষ্টি শক্তিকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি । 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ের প্রতীক

সংস্কৃত পণ্ডিত হলেও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনোরূপ মিথ্যা আক্রোশ ছিল না । পাশ্চাত্য আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল । এককথায় তিনি ছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয়ের মূর্ত প্রতীক । তারই আগ্রহে সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি পঠনপাঠন শুরু হয় । সংস্কৃত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক করা হয় ।  

ঈশ্বরচন্দ্র অধ্যক্ষ হিসেবে সংস্কৃত কলেজে অনেকগুলি প্রগতিশীল নিয়ম চালু করেন । প্রথমেই তিনি কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত নিয়মকানুনকে সর্বজনীন করেন । এতদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র হিন্দু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যরাই সংস্কৃত কলেজে শিক্ষালাভের অধিকারী ছিল । ঈশ্বরচন্দ্র যেকোনো হিন্দুর নিকট ওই কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন । সুলেখক হিসেবেও তিনি অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন । 

জনপ্রিয় লেখক

পাঠক্রম রচনায় তিনি মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দেন । বাংলা ভাষায় ‘ সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ’ এবং ‘ ব্যাকরণ কৌমুদী ‘ রচনা করে তিনি বাংলার মাধ্যমে সংস্কৃত সাহিত্যের শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করে দেন । জনশিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেন ‘ বর্ণমালা’ , ‘ কথামালা ’ , ‘ বোধোদয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ । কিশোর মনে তাঁর এই রচনাগুলির প্রভাব আজও সমানভাবে বর্তমান । তার ‘ বর্ণপরিচয় ’ বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে আজও স্বীকৃত । 

শিক্ষা সংস্কার 

শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষা বিস্তারে ছিলেন আন্তরিক আগ্রহী । বিশেষত স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় । মানবতাবাদী সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র ভারতীয় নারীর সামাজিক লাঞ্ছনা দেখে বিচলিত হন । তিনি উপলব্ধি করেন যে , অশিক্ষাই নারীজাতির এই দুর্দশার অন্যতম প্রধান কারণ । তিনি এও বুঝেছিলেন যে , সমাজ জীবনের উন্নতির জন্য স্ত্রী শিক্ষা অপরিহার্য । এজন্য তিনি নিজ উদ্যোগে প্রায় ৩৫ টি নারী – বিদ্যালয় স্থাপন করেন । এর মধ্যে কয়েকটি তিনি নিজব্যয়ে চালাতেন ।  

বাংলায় স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের ইতিহাসে ‘ বেথুন স্কুলের ’ নাম উল্লেখযোগ্য । জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । বিদ্যালয় পরিদর্শক ( Inspector of Schools ) হিসেবে তিনি নতুন বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ করে যান । 

বিধবা বিবাহ প্রচলন 

নিপীড়িত ভারতীয় নারী সমাজের দুঃখদুর্দশা লাঘবের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন । কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রথম উৎসর্গ ছিল নারীজাতি । পুরুষ শাসিত সমাজে গোঁড়া হিন্দু পুরুষেরা বিভিন্ন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে এমন কতকগুলি সামাজিক বিধিবিধান চালু করেছিল , যাতে নারীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বার্থান্ধ পুরুষের সুখ সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হত । যেমন— বাল্যবিবাহ , বহুবিবাহ ইত্যাদি ।  

এই বাল্য বিবাহের অনিবার্য অভিশাপ রূপে সমাজে সৃষ্টি হত সংখ্যাহীন বিধবার । কৌলীন্য প্রথার অজুহাতে কুলীন ব্রাহ্মণগণ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বহু পত্নী গ্রহণ করে মৃত্যুমুখে পতিত হত । ফলে বালিকা বধূগণ বিধবা হয়ে জীবনভোর অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করত । জীবনের বোধোদয় হবার পূর্বেই শতশত বালিকার জীবনের মুক্ত দুয়ার রুদ্ধ হয়ে যেত ।  

এই জঘন্য প্রথা বিদ্যাসাগরের অন্তরকে ব্যথিত করে তোলে । তাই তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন । এই কাজ করতে গিয়ে তাঁর বহু শত্রু সৃষ্টি হয়েছিল । রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করতে চেষ্টা করেছিল । এমনকি তাঁর প্রাণহানিরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল । কিন্তু কোনো বাধাই ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর সাধনা থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি ।  

সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত বিদ্যাসাগর হিন্দুশাস্ত্র বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন যে , হিন্দুধর্মের বিধবা বিবাহ স্বীকৃত । পরাশর সংহিতা একটি শ্লোক বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেন যে , স্বামী নিরুদ্দেশ হলে , মারা গেলে , পুরুষত্বহীন হলে , সংসারধর্ম ত্যাগ করলে কিংবা পতিত হলে স্ত্রীগণ পুনরায় বিবাহ করিতে পারেন ।  

বিধবা বিবাহের সমর্থনে তিনি ‘ তত্ত্ববোধিনী ‘ পত্রিকার দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন । ব্যক্তিগত উদ্যোগে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি এক হাজার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের নিকট জমা দেন ( ১৮৫৫ খ্রিঃ ) । বাংলা , বোম্বাই , মাদ্রাজ , নাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও বিধবা বিবাহ সমর্থন করে বহু দরখাস্ত সরকারের দপ্তরে জমা পড়ে । শেষ পর্যন্ত ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ বিধিবদ্ধ করে সরকার আইন জারি করেন । ওই বছরই বিদ্যাসাগরের প্রেরণা ও ব্যবস্থাপনায় কলকাতায় সর্বপ্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ( ৭ ই ডিসেম্বর ) । তাঁর চেষ্টায় পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে পঁচিশটি বিধবার পুনর্বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল ।  

তবে বিধবা বিবাহ আইনানুগ হলেও এর ব্যাপক প্রচলন সম্ভব হয়নি । এই বিফলতার কয়েকটি প্রধান কারণ হল — 

( ১ ) অশিক্ষার দরুন সাধারণ মানুষ এমনকি নারীরাও এই প্রথার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি । 

( ২ ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও ভূমিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সম্পত্তিতে পুরুষের একচেটিয়া প্রাধান্য থাকার ফলে পুরুষ শাসিত সমাজ এই ব্যবস্থাকে বরণ করেনি । 

( ৩ ) সংস্কার আইনগুলি কেবলমাত্র শহুরে শ্রেণির মধ্যেই প্রচারিত হয়েছিল । গ্রামীণ দরিদ্রশ্রেণি এইসব আইন সম্বন্ধে অন্ধকারে ছিল । অবশ্য সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঈশ্বরচন্দ্র এই আইন প্রবর্তন করে নারীজাতিকে একটি দীর্ঘকালীন অভিশাপ থেকে মুক্ত হবার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন । 

অন্যান্য সামাজিক সংস্কার 

বিধবা বিবাহের ন্যায় শিশু বিবাহ এবং বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র আন্দোলন করেন । সামাজিক অভিশাপ স্বরূপ এইসব কুপ্রথা বন্ধ করার জন্য তিনি জনমত গঠন করতে উদ্যোগী হন । এই কাজে এগিয়ে আসার জন্য তিনি সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেন । বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ রচনা করে তিনি প্রমাণ করেন যে , সনাতন হিন্দুধর্মে এবং শাস্ত্রে এইসব প্রথার নির্দেশ দেওয়া হয়নি । শাস্ত্রের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা থেকেই এইসব জঘন্য প্রথা চালু হয়েছে । সফল না হলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান । 

বাংলা ভাষার আধুনিকীকরণ

আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্রের ভূমিকা স্মরণীয় । নিজে রচনাবলীর মধ্যেও তিনি আধুনিক বাংলা গদ্যরীতির বিবর্তনে পথিকৃতের কাজ করেন । ইতিপূর্বে বাংলাভাষা ছিল সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত । অলংকারবহুল বাংলা ভাষা স্বভাবতই ছিল জটিল এবং অবোধ্য ।  

বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে যথাসম্ভব সংস্কৃত প্রভাবমুক্ত করে স্বাতন্ত্র্য দান করতে প্রয়াসী হন । তিনি নতুন ছন্দে বাংলা গদ্য রচনা করে বাংলা ভাষাকে অনেক বেশি সহজ ও সরল করে দেন । এরই উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কালে আধুনিক বাংলা ভাষার বিবর্তন ঘটেছে । গদ্যরচনায় ‘ ছেদ ‘ চিহ্নের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি । সেই সঙ্গে পদবিন্যাস দ্বারা বাংলা রচনাকে সাবলীল করে দেন ।  

মহামানব ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর মানবতাবাদ , কপটতাবর্জিত ব্যবহার , দীনদরিদ্র ও নির্যাতিতদের জন্য অপার করুণা , সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা এবং ন্যায় ও সত্যের জন্য দ্বিধাহীন সংগ্রামের প্রতিমূর্তি রূপে ভারতবাসীর হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । প্রাচ্য সংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের আলোকে পুনরালোকিত করার জন্যই অমলেশ ত্রিপাঠী তাকে যথার্থই বলেছেন : ” A traditional moderniser . “

error: Content is protected !!