ইতিহাস

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

Contents

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত 

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতীয় রাজস্ব সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । স্থায়ী ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণের চিন্তা ভাবনা ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময় থেকেই গভীরভাবে শুরু হয়েছিল । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশ্নে ডাইরেক্টর সভা ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দৃষ্টি প্রধানত স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস্-এর চেষ্টাতেই আকৃষ্ট হয়েছিল । পিটের ভারত শাসন আইন ১৭৮৪ -র ৩৯ নং বিধানেও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব স্থায়ী ভিত্তিতে নির্ধারণের নির্দেশ ছিল ।  

লর্ড কর্নওয়ালিশ ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতেও এক ভৌমিক অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করার পক্ষপাতী ছিলেন । তাই তিনি প্রথমে এদেশের রাজস্বের পরিমাণ , বিভিন্ন এলাকায় জমির মূল্য এবং প্রজাকুলকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে যত্নবান হন । এই ব্যাপারে কর্নওয়ালিশ সব দায়িত্ব দেন জন শোরকে ।  

শোর ১৫৮২ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ টোডরমল থেকে মিরকাশিম পর্যন্ত বাংলার রাজস্ব বন্দোবস্তের সমীক্ষা ও পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য তিন প্রকারের রাজস্ব বন্দোবস্তের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন , যথা — রায়তদের সাথে সরাসরি বন্দোবস্ত , জোতদারদের সাথে বন্দোবস্ত এবং জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত । অবশ্য কোম্পানির আর্থিক নিরাপত্তা ও দেশের উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে জন শোর জমিদারদের সাথেই বন্দোবস্তের সপক্ষে অভিমত দেন । কিন্তু রাজস্ব বোর্ডের সদস্য জেমস গ্রান্ট জমিদারদের সাথে বন্দোবস্তের বিরোধিতা করেন । 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা 

কর্নওয়ালিশ ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের সাথেই দশ বছরের ভিত্তিতে জমি বন্দোবস্ত করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেন যে , ডাইরেক্টর সভা কর্তৃক অনুমোদিত হলে এই বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী করা হবে । এই দ্বিতীয় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জন্ শোরের সাথে কর্নওয়ালিশের তীব্র মতভেদ দেখা দেয় । শোরের যুক্তি ছিল এই যে , যথাযথভাবে জমি জরিপ না করে এবং জমির মূল্য ও উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারণ না করে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া ঠিক নয় । তিনি এও বলেন , যে কোনো কারণে ডাইরেক্টর সভা যদি এই বন্দোবস্ত অনুমোদন না করেন , তাহলে জমিদার ও প্রজা সবার কাছেই কোম্পানির হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে ।  

তা ছাড়া জমিদারগণকে যদি জমির মালিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয় , তা হলে রায়তদার ও জমিদারদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে কোম্পানির কোনো ক্ষমতা থাকবে না । তাই শোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তের সুপারিশ করেন । কিন্তু কর্নওয়ালিশ নিজ সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন এবং ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে সেপ্টেম্বর ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন এসে পৌঁছলে তিনি , ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মার্চ দশসালা বন্দোবস্তুকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা করেন ।   

এই ব্যবস্থার দ্বারা কোম্পানিকে বাৎসরিক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা প্রদানের বিনিময়ে জমিদারগণকে জমির মালিক বলে স্বীকার করা হয় এবং বংশানুক্রমে তাদের জমিদারি নিলাম করার নীতিও গৃহীত হয় । 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণ 

লর্ড কর্নওয়ালিশ ভারতে ভূমি বন্দোবস্তের আমূল সংস্কার করেন । তিনি স্বল্পমেয়াদি বন্দোবস্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখান । তাঁর মতানুযায়ী কোম্পানির কর্তৃপক্ষ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অনুমতি দেন । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় । চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে স্থির হয় , 

( i ) সর্বোচ্চ নিলাম দাতাকে বন্দোবস্ত দেওয়া হবে । 

( ii ) জমিদাররা নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বংশানুক্রমে জমি ভোগদখল করবেন । 

( iii ) জমিদার জমি হস্তান্তরের অধিকার পাবেন । 

( iv ) নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব মেটাতে ব্যর্থ হলে সূর্যাস্ত আইন অনুসারে সরকার উক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে পুনরায় নিলাম ডেকে বন্দোবস্ত দিতে পারবেন । 

কর্নওয়ালিশ এই ধরনের ভূমি ব্যবস্থার মৌল উদ্ভাবক ছিলেন না । বহু পূর্বেই ফ্রান্সের ফিজিওক্র্যাটিক অর্থনৈতিক মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো কোনো ব্রিটিশ চিন্তাবিদ স্থায়ী ভিত্তিতে জমি বন্দোবস্ত দেবার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেন । তাঁরা মনে করতেন যে , জমিই একটা দেশের রাজস্বের প্রধান উৎস । তাই উৎপাদন ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশ আবশ্যিক এবং এজন্য জমির উপর কোনো প্রকার সরকারি হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত । এই মতের সমর্থক হেনরি পাটুলো ( Pattullo ) ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক গ্রন্থে বাংলার ভূমি সম্পদের এক গভীর বিশ্লেষণ করে স্থায়ী বন্দোবস্তের সুপারিশ করেন । 

লর্ড কর্নওয়ালিশ তাঁর ‘ মিনিটে ’ ( Minute ) জমিদারদের সম্পর্কে যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন , তার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ মনে করেন কর্নওয়ালিশ নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে স্থায়ী ভাবে বন্দোবস্তের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । কোম্পানির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণ-অসন্তোষ ও বিক্ষোভের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও অনুগতশ্রেণি হিসেবে জমিদারদের কাছে পাওয়ার জন্যই কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি আকৃষ্ট হন ।  

কর্নওয়ালিশ বাংলার দুর্বল কৃষি ব্যবস্থার উন্নতি এবং কৃষক শ্রেণির সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানির বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাচীন জমিদার শ্রেণির হাতে স্থায়ি ভাবে জমির স্বত্ব তুলে দিতে চেয়েছিলেন । 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল  

বাংলা তথা ভারতের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রাচীনকাল থেকেই নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে । কোম্পানি দেওয়ানি পাওয়ার পরবর্তী কালে ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমে দশশালা বন্দোবস্ত এবং পরে একশালা বন্দোবস্ত চালু করেন । কিন্তু কোনোটাই বাঞ্ছিত ফল দিতে পারেনি ।  

কর্নওয়ালিশ দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশের ভূমিসম্পদ বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানের বন্দোবস্তের সপক্ষে মত দেন । তাঁর কাউন্সিল সদস্যদের কারও কারও আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে দশ বছরের বন্দোবস্ত দেন এবং ওই বন্দোবস্তুকেই ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ী বন্দোবস্তু হিসেবে স্বীকৃত দেন ।  

বাংলার তথা কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । এর আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক ফল সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই ।চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ্‌গণের মধ্যে সুস্পষ্ট মতভেদ আছে ।  

সমালোচকদের মতামত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় , চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল । বাস্তবে এই অবস্থা কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছিল , তা তার পরবর্তী প্রভাব বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় । অর্থনৈতিক , সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার সুফল ও কুফল দুইই পরিলক্ষিত হয় । 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল 

( ১ ) অর্থনৈতিক সুফল : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল মূলত কোম্পানির তরফেই পরিলক্ষিত হয়েছিল । ইতিপূর্বে গৃহীত রাজস্ব ব্যবস্থাগুলিতে সরকারের বাৎসরিক আয় কখনোই সুনির্দিষ্ট হয়নি । স্বাভাবিকভাবেই অনিশ্চিত আয়ের উপর নির্ভর করে বাৎসরিক আয় ব্যয়ের হিসাব ( Budget ) যথাসময়ে সম্পন্ন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হত না । কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হলে রাজস্ব আয়ের এই অনিশ্চয়তা দূর হয় এবং সরকারের পক্ষে বাৎসরিক বাজেট সুনিশ্চিতভাবে তৈরি করা সহজতর হয় ।  

দ্বিতীয়ত , বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী হওয়ার ফলে এবং জমির মালিকানা জমিদারদের হস্তগত হওয়ার ফলে , বহুক্ষেত্রেই দেশের সামগ্রিক কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । অর্থাৎ মালিকানা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার ফলে বহু জমিদার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চাষ আবাদযোগ্য ভূমিকে চাষযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত করার জন্য সংস্কারে উদ্যোগী হন । সেই সময়ে কোম্পানির রাজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জঙ্গলময় ছিল । এর বেশ কিছুটা অংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলেই চাষ জমিতে রূপান্তরিত হয়েছিল ।  

তৃতীয়ত , এই ব্যবস্থা গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশের পথকেও অনেকাংশে উন্নত করেছিল , যদিও তা ছিল খুবই সীমিত ও সাময়িক । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারগণই স্ব স্ব এলাকাহীন অঞ্চলের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন । তাই তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষি উন্নয়নের সাথে সাথে গ্রামীণ কুটিরশিল্পের বিকাশও পরিলক্ষিত হয়েছিল । 

( ২ ) সামাজিক সুফল : বাংলার সামাজিক জীবনেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কিছু সুফল পরিলক্ষিত হয়েছিল । ইতিপূর্বে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের যে হার ছিল , চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে তা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল । এলাকা সীমিত ( Limited ) হওয়ার ফলে জমিদারগণ নিজ নিজ এলাকার অভাব অভিযোগ সম্বন্ধে খুব সহজেই অবহিত হতে পারতেন এবং তার প্রতিবিধান করতে পারতেন । খানিকটা সংস্কার মানসিকতা ও খানিকটা প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তি নিয়ে বহু জমিদারই স্ব স্ব এলাকার অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে ব্রতী হয়েছিলেন ।  

এইভাবে গ্রামগুলিতে গড়ে উঠেছিল বিদ্যালয় , পানীয় জলের জন্য সুসংস্কৃত পুষ্করিণী , সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসালয় , আমোদ প্রমোদের জন্য রঙ্গমঞ্চ , যোগাযোগের জন্য পথঘাট প্রভৃতি । এগুলি গ্রামজীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল , এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । অবশ্য জমিদারদের ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতার প্রভেদহেতু এই গ্রামীণ বিকাশের হার ছিল বিভিন্ন রকমের । 

( ৩ ) রাজনৈতিক সুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল বহুলাংশে সুপ্ত ; কিন্তু অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ । মুঘল আমলে জমিদারগণ রাজস্ব আদায় ছাড়াও বহু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন । প্রকৃতপক্ষে নিজ নিজ এলাকায় জমিদারগণ ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী । স্বভাবতই তারা দুর্বল সম্রাটদের আমলে অরাজকতা সৃষ্টি করতেন ।  

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কর্নওয়ালিশ জমিদারদের প্রচুর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করেন । ফলে এই সময়ে তাদের সরকার বিরোধী প্রবণতা কমে যায় । ফলে সরকারের হাতে আসে রাজনৈতিক ক্ষমতা আর জমিদারদের হাতে থাকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা । এর বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব এই যে , এই ব্যবস্থা কেবল জমিদারদের বিদ্রোহী বা অরাজক মানসিকতা দূর করে তাই নয় , এরা কোম্পানির এক বিশেষ অর্থশালী ও প্রভাবশালী সমর্থকে পরিণত হন । যা পরবর্তীকালে কোম্পানির অগ্রগতির পথকে সহজতর করে তুলেছিল । 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলগুলি ছিল সীমিত ও তাদের প্রভাব ছিল অদূরপ্রসারী । কিন্তু এই ব্যবস্থার কুফলগুলি ছিল অসংখ্য ও প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী । ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার যুক্তিপূর্ণভাবে এই অপগুণগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন । 

( ১ ) কোম্পানির রাজস্ব ক্ষতি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কর্নওয়ালিশ বা ডাইরেক্টর সভার কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি । অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোম্পানি তার সম্পর্কে খানিকটা নিশ্চিত হলেও , এই ব্যবস্থার অচলায়তনের ফলে কোম্পানি পরবর্তীকালে রাজস্ব বৃদ্ধি সংক্রান্ত সুযোগ – সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল । আসলে কোম্পানি তাৎক্ষণিক সুবিধার কথা চিন্তা করে বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী করেছিল । তাই দূরদৃষ্টির অভাবহেতু তারা জমির মূল্য বৃদ্ধিজনিত লাভের ( Unearned inerement ) অংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল । 

( ২ ) কৃষকদের দুর্দশা : সাধারণ কৃষক সমাজের উপর এর অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল খুবই বিপজ্জনক । কারণ কোম্পানি জমিদারদের সাথে বন্দোবস্ত চিরস্থায়ীভাবে ও রাজস্বের হার নির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করলেও জমিদারগণ রায়তদারদের সাথে কোনোরূপ অস্থায়ী চুক্তিতে আবদ্ধ হননি । কিন্তু কৃষকদের কাছ থেকে ক্রম উচ্চহারে রাজস্ব আদায়ের প্রবণতা ছিল স্থায়ী । ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রায়তগণ নিঃশেষ হয়েও জমিদারকে খাজনা প্রদান করতে বাধ্য হত । অসহায় কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারদের লাঠিয়ালদের জুলুম ছিল নিয়মিত ঘটনা ।  

শুধু তাই নয় , জমির উপর রায়তদের অধিকার ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত । এই প্রসঙ্গে কয়েকটি আইনের উল্লেখ করা যায় । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নং ধারায় জমিদারগণ বিচার বিভাগের অনুমতি ছাড়াই রায়তের ফসল , গবাদি পশু বা অন্যান্য স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দখল করার অধিকার লাভ করেন । অবশ্য এর বিরুদ্ধে দেওয়ানি আদালতে আপিল করার বিধান থাকলেও , প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব চাষির পক্ষে সেই ন্যায় বিচারের দ্বারস্থ হওয়া ছিল অলীক কল্পনা মাত্র ।  

১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩৫ নং রেগুলেশন দ্বারাও জমিদারদের হাতে আরও কিছু কঠোর অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় । জমিদারদের হাতে প্রজাশোষণের সবথেকে বড়ো অস্ত্রটি তুলে দেওয়া হয় ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ নং রেগুলেশন দ্বারা । এতে বলা হল , খাজনা বাকি পড়লে জমিদার অনাদায়ী প্রজার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এমনকি তাকে বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত পর্যন্ত করতে পারবেন । এই সকল আইনের ফলে রায়ত কৃষকের স্বার্থ জমিদারদের পদতলে পিষ্ট হয় ।  

সিরাজুল ইসলাম একে “ ব্রিটিশ শাসনের প্রথম কালা আইন ” বলে অভিহিত করেছেন । ড. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের ভাষায় : “ It gave a blank cheque to the Zamindar .” এই আইনের সাহায্যে জমিদাররা অকারণে এবং বেশি অর্থের লোভে যখন তখন রায়তদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতেন । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সবথেকে বড়ো ত্রুটি হল যে , এই ব্যবস্থায় কৃষকদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার কোনো বিধান ছিল না । 

( ৩ ) শিল্প বাণিজ্য হ্রাস : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শিল্প ও বাণিজ্যে অর্থ বিনিয়োগের হার প্রচণ্ডভাবে হ্রাস করে । শিল্পপতি ও বণিক সম্প্রদায় অনিশ্চিত শিল্প ও বাণিজ্যে অর্থবিনিয়োগের পরিবর্তে স্থায়ী মালিকানার শর্তে জমিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ বোধ করেন । অবশ্য প্রশাসনিক ক্ষমতার মোহও তাঁদের একাজে উৎসাহিত করেছিল ।  

এইভাবে রাজস্ব ব্যবস্থায় একশ্রেণির ফড়ে মহাজনের আগমন ঘটেছিল , যা পরিণতিতে রাজস্ব  শাসনের ক্ষতিই করেছিল । এদের আগমনে , বহু বনেদি জমিদার যেমন পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল , তেমনি এদের অজ্ঞানতাজনিত অত্যধিক নিলামদর প্রদানের ফলে রায়ত ও কৃষকদের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল ।  

এই ত্রুটিই পরবর্তীকালে একাধিক নতুন জটিলতার জন্ম দিয়েছিল । যেমন এদের সাথে নিলামে পাল্লা দেওয়ার জন্য বহু বনেদি জমিদার , যাঁরা চাষবাস সংক্রান্ত বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ , তাঁরা জেনেশুনেই জমিদারি দখলের জন্য অবাস্তব রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন । পরিণতিতে ‘ সূর্যাস্ত আইনের ‘ বাঁধনে পড়ে অনেকেই জমিদারিচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছিলেন ।  

ফলে ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ জমিদারদের পরিবর্তে অনভিজ্ঞ মহাজনদের হাতে অধিকাংশ জমিদারি চলে গিয়েছিল । আবার এঁরাও কৃষকদের উপর চরম নির্যাতন করেও অনাদায়ী ( Defaulter ) হয়ে জমিদারি রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতেন । ফলে কোম্পানিকে অনর্থক বহু মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল । এতে অর্থব্যয় ও রাজস্ব আদায়ে অনিশ্চয়তা দুই ধরনের সমস্যাই সৃষ্টি হয়েছিল । 

( ৪ ) জমির খণ্ডীকরণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আর একটি অপ্রত্যাশিত কুফল ছিল ‘ পাটনি ’ প্রথার সূত্রপাত । বড়ো বড়ো জমিদাররা খাজনা আদায়ের অসুবিধার কারণে নিজেদের জমিদারি ছোটো ছোটো ভাগ করে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে অন্যকে বিক্রি করে দিতে শুরু করেন । এই বিভক্ত জমিগুলিকে বলা হত ‘ পাটনি ’ এবং ক্রেতাদের বলা হত ‘ পাটনিদার ’ । পাটনিদাররা আবার নিজেদের জমিকে বিভক্ত করে বিক্রি করতেন , যারা কিনত , তাদের বলা হত ‘ দূর পাটনিদার ’ । এরা আবার অতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে বিক্রি করত । এদের বলা হত ‘ দূর দূর পাটনিদার ‘ ।  

পাটনি প্রথার প্রবর্তনের ফলে মধ্যবর্তী জমির মালিকদের প্রজা উৎপীড়ন ও শোষণ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল । ক্রমবর্ধমান খাজনার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজীবীদের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হয় , তাদের অভাব ও দারিদ্র্য অপরিসীম হয়ে পড়ে । 

( ৫ ) গ্রামের দুর্দশা বৃদ্ধি : বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী হওয়ার ফলে , কালক্রমে বহু জমিদার গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করতে শুরু করেন এবং নায়েব-গোমস্তা মারফত জমিদারি পরিচালনা ও রাজত্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন । এই অবস্থায় অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নায়েব-গোমস্তারা কৃষকদের উপর অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং তা আদায়ের জন্য নিপীড়ন শুরু করে । কৃষকদের আর্থিক দুর্দশা যেমন বৃদ্ধি পায় , গ্রামাঞ্চলের সামাজিক উন্নয়নও ব্যাহত হতে থাকে । গ্রামের সম্পদ শহরে ব্যয়িত হওয়ার ফলে গ্রামগুলি শ্রীহীন হতে শুরু করে , নতুন পথঘাট নির্মাণ , বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রায় বন্ধই হয়ে যায় , এমনকি পুরোনোগুলোর সংস্কারকাজও ব্যাহত হতে থাকে । 

( ৬ ) জমির উন্নয়ন ব্যাহত : কর্ণওয়ালিশ আশা করেছিলেন স্থায়ীভাবে মালিকানা পেলে জমিদারগণ ব্যাপক হারে জমির উন্নয়নে উদ্যোগী হবেন । কিন্তু স্থায়ী মালিকানা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের উন্নয়নে উদ্যোগী করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই উদ্যোগ ছিল সাময়িক । ফলে বহু জমিই অনবাদী পড়েছিল । 

( ৭ ) সামাজিক অবক্ষয় : পরিশেষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার আর একটি দিকের উল্লেখ প্রয়োজন । এই ব্যবস্থার ফলে বার্ষিক বৃত্তিভোগী ইংরেজ আনুকূল্য পুষ্ট অলস একশ্রেণির মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল । এঁদের মধ্যে বিত্ত ও বৈভব প্রদর্শনের ব্যয়বহুল ও অশোভন প্রতিযোগিতা দেখা দেয় । বাংলার সমাজ ও ধর্মজীবনে তার অশুভ প্রভাব ছিল অবশ্যম্ভাবী ।

error: Content is protected !!