ইতিহাস

ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ এর কারণ ও ফলাফল

Contents

ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ এর কারণ ও ফলাফল

রণজিৎ সিংহের মৃত্যুর ( ১৮৩৯ খ্রিঃ ) পর শিখ শক্তি দ্রুত অধঃপতনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল । সুযোগ্য নেতার অভাব , শিখ সর্দারদের ক্ষমতার প্রতি লোভ , খালসা বাহিনীর অতি ক্ষমতা লাভ প্রভৃতি কারণে এই অধঃপতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ।

রণজিৎ সিংহের পরবর্তী শিখ নেতাগণ

রণজিৎ -এর মৃত্যুর পর শিখ নেতা হন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খড়ক সিংহ । কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তিনি মারা যান ( ১৮৪০ খ্রিঃ ) । পরদিনই আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাঁর সুযোগ্য পুত্র নৌনেহাল সিংহ প্রাণ হারান । তখন রণজিৎ সিংহের অপর পুত্র শের সিংহ রাজ্যভার গ্রহণ করেন । কিন্তু তিন বছরের মাথায় তিনিও আততায়ীর হাতে নিহত ( ১৮৪৩ খ্রিঃ ) হন । এই অনিশ্চয়তার মাঝে রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা ‘ খালসা ’ বাহিনীর হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে । খালসা বাহিনীর দুই নায়ক লাল সিংহ ও তেজ সিংহ রণজিৎ সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র দলীপ সিংহকে সিংহাসনে বসিয়ে সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করে । রানী মাতা ঝিন্দন দলীপ সিংহের অভিভাবিকা নিযুক্ত হন ।

শিখদের অন্তর্দ্বন্দ্ব

শিখ সর্দারগণ সাহসী হলেও অত্যন্ত স্বার্থপর ও ক্ষমতা লোভী ছিলেন । রাজমাতা ঝিন্দন দলীপ -এর অভিভাবিকা হলেও তাঁর হাতে প্রকৃত অর্থে কোনো ক্ষমতা ছিল না । কেবল সামরিক নয় , প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বও খালসা বাহিনীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল । এই সময় আফগানদের হাতে ইংরেজ বিপর্যয় ঘটতে দেখে শিখ খালসা বাহিনী আরও উন্মত্ত হয়ে উঠে । তারা কল্পনা করে নেয় যে , ‘ খালসা’বাহিনী অপ্রতিরোধ্য । এদিকে খালসা বাহিনীর এই সর্বগ্রাসী ক্ষমতা লোভী রানী ঝিন্দনও অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন । খালসা বীরদের রণহুঙ্কার ও ইংরেজ বিদ্বেষকে আপন স্বার্থে তিনিও ইন্ধন দিতে থাকেন । ঝিন্দনের দুটি উদ্দেশ্য ছিল । যথা— 

( ১ ) খালসা বাহিনীর স্বাভাবিক উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরস্থ শিখ রাজ্যগুলো দখল করতে পারলে শিখ রাজ্যে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে , এবং 

( ২ ) যদি তা সম্ভব না-ও হয় , তাহলে ইংরেজের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে খালসা বাহিনী অন্তত কিছুটা শক্তিহীন হয়ে যাবে । সেক্ষেত্রে রানীমাতা রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনর্দখল করতে পারবেন ।

প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ

ইতিমধ্যে ইংরেজগণও পাঞ্জাবের শত্রুতার আশঙ্কা করে সীমান্ত দুর্গগুলিতে সৈন্য সমাবেশ করতে থাকেন । তা ছাড়া , পাঞ্জাবের প্রতি ইংরেজের নজর অনেক দিনের । লর্ড অকল্যান্ড এবং লর্ড এলেনবরা বহু পূর্বেই ঘোষণা করেছিলেন যে , ইংরেজ কর্তৃক পাঞ্জাব অধিকার অনিবার্য । যাই হোক , সীমান্তে ইংরেজের সেনা সমাবেশ খালসা বীরদের যুদ্ধস্পৃহা দ্বিগুণ করে তোলে ।  

১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে খালসা বাহিনী শতদ্রু নদী অতিক্রম করে ইংরেজ অধিকৃত অঞ্চলে ঢুকে পড়লে ইংরেজ বাহিনী গতিরোধ করে । শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ । ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন জেনারেল হিউগাফ । একমাত্র লুধিয়ানার যুদ্ধে শিখরা কিছুটা সাফল্য অর্জন করে । কিন্তু মুদকী , ফিরোজ শা , আলিওয়াল ও সুব্রাও ’ – এর যুদ্ধে (ডিসেম্বর ১৮৪৫ – ফেব্রুয়ারী ১৮৪৬ খ্রিঃ ) শিখ বাহিনী বিপর্যস্ত হয় । শিখদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল লাল সিংহের বিশ্বাসঘাতকতা এবং ইংরেজ সেনাপতির রণকৌশল । পরাজিত শিখগণ লাহোরের সন্ধি ( ১৮৪৬ খ্রিঃ ) স্বাক্ষর করলে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের অবসান ঘটে ।

লাহোরের সন্ধি

লাহোরের সন্ধি দ্বারা –

( ১ ) ইংরেজ কোম্পানি শিখদের কাছ থেকে জলন্ধরদোয়াব লাভ করে ।

( ২ ) লাহোর দরবার যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় মিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করতে স্বীকৃত হয় । কিন্তু অর্থাভাবের দরুন নগদ অর্থের পরিবর্তে শিখগণ কাশ্মীর ইংরেজের হাতে তুলে দেয় । কোম্পানি জনৈক ডোগরা গুলাব সিংহের নিকট কাশ্মীর বিক্রি করে দেয় ।

( ৩ ) লাহোর দরবারের অধীনে শিখ সৈন্যের সংখ্যা হ্রাস করা হয় ।

( ৪ ) লাহোরে একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখার ব্যবস্থা করা হয় । কয়েকমাস পরে স্বাক্ষরিত আর এক সন্ধি দ্বারা , ব্রিটিশ রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে আটজন শিখ সর্দারকে নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিলের উপর পাঞ্জাবের শাসনভার অর্পিত হয় । লাহোরে একদল ইংরেজ সৈন্য মোতায়েন রাখা হয় । এই বাহিনীর ব্যয়ভার লাহোর দরবারের উপর বর্তায় ।

শিখদের অসন্তোষ 

প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে জয়লাভের পর লর্ড হার্ডিঞ্জ শিখরাজ্যকে ইংরেজ কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে না আনলেও , পাঞ্জাবে ও শিখ দরবারে ইংরেজের প্রভুত্ব পুরোপুরি ভাবেই স্থাপন করেছিলেন । শিখগণ এই ব্যবস্থায় মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না । ক্ষমতাচ্যুত হলেও সাহসী ও আত্মগর্বী খালসা বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল । পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল । সেই সঙ্গে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জন লরেন্স  এর কার্যকলাপ শিখ নেতাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে । লরেন্স সামান্য অজুহাতে স্বাধীনচেতা শিখ নেতাদের বিতাড়িত করে লাহোর দরবারে দুর্বল করে দিতে চেষ্টা করেন । তিনি ইংরেজের বিরোধিতার কারণে লাল সিংহকে লাহোর দরবার থেকে বিতাড়িত করেন এবং রানীমাতা ঝিন্দনকে বন্দি করে চূনার দুর্গে নিক্ষেপ করেন । এইসব ঘটনা শিখ শক্তিকে বিদ্রোহী করে তোলে ।

ডালহৌসীর নীতি 

তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী ছিলেন গোঁড়া সাম্রাজ্যবাদী শাসক । সামান্য অজুহাতে দেশীয় রাজ্যগ্রাসে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত । শিখ বাহিনীর ও শিখজাতির এই বিক্ষোভ তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না । তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন একটা যুদ্ধ সৃষ্টির । কারণ তিনি জানতেন , দুর্বল খালসা বাহিনীকে পরাজিত করা কষ্টসাধ্য হবে না ।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ 

মুলতানের শাসনকর্তা মুলরাজের বিদ্রোহ ডালহৌসীর সামনে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ এনে দেয় । কোম্পানি মুলরাজকে বরখাস্ত করে অপর একজনকে মুলতানের শাসক নিযুক্ত করলেন । দুজন ইংরেজ কর্মচারী নবনিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বপদে বহাল করতে মুলতানে উপস্থিত হলে মুলরাজ তাদের হত্যা করলেন । মুলরাজকে দমন করার জন্য শের সিংহ -কে পাঠানো হয় । কিন্তু তিনিও বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেন । আফগানগণও শিখদের পক্ষে যোগদান করে । অন্যান্য অঞ্চলেও ইংরেজ নিধন শুরু হল । সঙ্গে সঙ্গে ডালহৌসী শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন । শুরু হল ‘ দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধ ’ ( ১৮৪৮ খ্রিঃ ) । চিলিয়ান ওয়ালার যুদ্ধে শিখ বাহিনী জয়লাভ করে । কিছু সময় পরে ইংরেজ বাহিনী পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে শিখদের আক্রমণ করে । গুজরাটের যুদ্ধে শিখ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয় । শিখ নেতাগণ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন ( ১৮৪৯ খ্রিঃ ) ।

ইঙ্গ শিখ যুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে জয়লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ডালহৌসী সমগ্র পাঞ্জাবকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেন । সামান্য ভাতা প্রদান করে দলীপ সিংহকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হল । খালসা বাহিনী ভেঙে দেওয়া হল । ছোট্ট একটা কৃপাণ ভিন্ন অন্য কোনো অস্ত্রধারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল । হেনরি লরেন্সকে চিফ কমিশনার নিযুক্ত করে তার হাতে পাঞ্জাবের শাসনভার অর্পিত হল । পাঞ্জাব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় আফগানিস্তানের সীমা পর্যন্ত কোম্পানির রাজ্য বিস্তৃত হল ।  

কোনো কোনো ঐতিহাসিক ডালহৌসী কর্তৃক পাঞ্জাবকে কোম্পানির রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তকে ‘ রাজনৈতিক ভ্রান্তি ‘ বলে উল্লেখ করেছেন । কারণ এর ফলে ইংরেজকে আফগান সমস্যায় বিব্রত হতে হয়েছিল । যদি পাঞ্জাবকে দখল না করে মিত্ররাজ্য হিসেবে রাখা হত , তাহলে আফগান সমস্যার আঁচ সরাসরি কোম্পানির গায়ে লাগত না ।

error: Content is protected !!