ইতিহাস

হায়দার আলীর কৃতিত্ব

হায়দার আলীর কৃতিত্ব

হায়দার আলী ছিলেন মুসলমান শাসকদের মধ্যে ‘ সর্বাপেক্ষা সহিষ্ণু ‘ শাসক  । তিনি নিরক্ষর হলেও তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর । পাঁচটি ভাষায় তিনি কথা বলতে পারতেন । তাঁর শাসন স্বৈরাচারী হলেও , তা কখনো স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে নামেনি । পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা , নিজ রাজ্যের স্বাধীনতা ও অগ্রগতির প্রতি আগ্রহ , সুশাসন প্রবর্তনে উদ্যোগ প্রভৃতি তাকে মহত্ত্ব দান করেছে । 

কিন্তু ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ  হায়দারের সমালোচনা করে বলেছেন , হায়দার ছিলেন “ ধর্ম , বিবেক ও দয়া মায়া বর্জিত অত্যাচারী শাসক ”। তবে অনেকের মতে এ বক্তব্য যুক্তি যুক্ত নয় । সম্ভবত হায়দারের ইংরেজ বিরোধিতার জন্যই স্মিথ এ ধরনের কথা বলেছেন । কপটতা , মিথ্যাচার , ধর্মদ্বেষ প্রভৃতি হায়দারের চরিত্রে আদৌ ছিল না । আজীবন রোগের কঠোর যন্ত্রণা সহ্য করেও তিনি রাজকর্ম করে গেছেন । তাই বলা চলে , যে সকল ভারত সন্তান বিদেশির পদলেহন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন , হায়দার আলী ছিলেন তাদের অগ্রণী পুরুষ এবং পথপ্রদর্শক । 

প্রতিভাবান শাসক 

হায়দার আলী সাধারণ সৈনিক রূপে জীবন শুরু করে অসামান্য বুদ্ধি ও কর্মক্ষমতার দ্বারা মহীশুরের সিংহাসন দখল করেন । প্রায় সারাজীবন তাঁকে শত্রুবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে । নিরক্ষর হলেও তার বুদ্ধির অভাব ছিল না । তাই তাঁর বুঝতে বিলম্ব হয়নি যে দেশের প্রধান শত্রু হল ইংরেজ । প্রশাসনিক ও সামরিক সংগঠনে তিনি সমান প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন । একাধিক শত্রুর সাথে লড়তে হলেও তিনি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হননি । কূটনীতিতেও তিনি কম দক্ষ ছিলেন না । অর্থ লোভী মারাঠা ও অনির্ভর নিজামকে ইংরেজ পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন করায় তিনি বহুবারই সফল হয়েছেন । 

প্রশাসক হিসেবে তিনি ছিলেন কঠোর ও কর্তব্যপরায়ণ । গভীর রাত পর্যন্ত তিনি রাজকার্যে লিপ্ত থাকতেন । সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রতি তার কোনোরূপ সহজাত বিদ্বেষ ছিল না । এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন । হিন্দু দেবস্থানের জন্য তিনি বহু নিষ্কর জমি দান করেন । কৃষি উন্নয়নের প্রতিও তাঁর নজর ছিল । পতিত জমি উদ্ধার , কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণদান , ইজারাদারদের উৎপীড়ন থেকে কৃষকদের রক্ষা করা প্রভৃতি কর্মসূচি দ্বারা তিনি কৃষকদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটান ।  

বস্তুত প্রশাসনের ক্ষেত্রে তিনি কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়তো ঘটাননি ; কিন্তু প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে সচল রাখার কাজে তিনি অবশ্যই সফল ছিলেন । পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যে মহীশূরের প্রাধান্য স্থাপন । বিদেশি ইংরেজ কোম্পানির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত ছিলেন । তাই ইংরেজের সাথে তিনি আপসহীন লড়াই চালিয়েছেন । কিন্তু প্রশাসনিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই তিনি শেষ পর্যন্ত বিফল হয়েছেন । এর কারণ হল– 

( ১ ) প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক কঠোর । কাজ ছাড়াও যে মানুষের জীবনে কয়েকটি দিকের প্রয়োজন , এ সত্য তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি । 

( ২ ) যুদ্ধ জয়ের জন্য কেবল শক্তি নয় , কূটনৈতিক চাতুর্যের যে উপযোগিতা আছে— তা-ও তিনি বুঝতে চাননি বা পারেননি । তাই সমগ্র জীবন সংগ্রাম করলেও হায়দার সার্বিক সাফল্য পাননি ।

error: Content is protected !!