তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ

ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি কোম্পানির স্বার্থের বিরোধী ছিল । এই সন্ধির দ্বারা টিপুর হাত বাঁধার কোনো ব্যবস্থা হয়নি । টিপু সুলতান ছিলেন স্বাধীনচেতা ও বিচক্ষণ শাসক । ভারতের বুকে বিদেশি ইংরেজের আধিপত্য তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি । তিনি জানতেন যে , ইংরেজ সরকার স্বাধীন ও স্বনির্ভর মহীশূর রাজ্যকে টিকতে দেবে না । তাই তিনি নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেন । এই উদ্দেশ্যে ফ্রান্স , কাবুল , তুরস্ক প্রভৃতি দেশে টিপু দূত পাঠান । ওইসব দেশের সাহায্য নিয়ে তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করেন । 

অন্যদিকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশও টিপু সুলতানের কাজকর্মে ক্ষুব্ধ ছিলেন । ফরাসিদের সঙ্গে টিপুর যোগাযোগে তিনি আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন । তাই তিনিও ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি ভঙ্গ করে মহীশূরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন । তিনি পরপর মারাঠা , পেশোয়া ও হায়দ্রাবাদের নিজামের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন । 

কর্নওয়ালিশ মিত্র রাজ্যের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন , কিন্তু মহীশূরকে সেই জোট থেকে বাইরে রাখেন । এই সংবাদে ক্ষুব্ধ টিপু কোম্পানির মিত্র রাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করেন । টিপু ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করায় , কর্নওয়ালিশ ঘোষণা করেন যে , ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি টিপু ভেঙে ফেলেছেন । কর্নওয়ালিশ-এর মহীশূর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের ( ১৭৯০-৯২ খ্রি . ) সূত্রপাত হয় । যুদ্ধে মারাঠা পেশোয়া ও নিজাম ইংরেজের পক্ষে যোগ দেন ।

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি 

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে মারাঠা , নিজাম প্রভৃতি ভারতীয় শক্তি ইংরেজের পক্ষে যোগ দেয় । টিপু এককভাবে দু-বছরই লড়াই চালিয়ে যান । কর্নওয়ালিশ স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এক সময় টিপুর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম ঘেরাও করেন । এমতাবস্থায় টিপু ‘ শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ‘ ( ১৭৯২ খ্রিঃ ) স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন । 

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধির শর্তানুসারে— 

( ১ ) টিপু তার রাজ্যের অর্ধাংশ ইংরেজের হাতে অর্পণ করেন । 

( ২ ) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনি নগদ অর্থ দিতে স্বীকৃত হন । 

( ৩ ) সন্ধির জামানত স্বরূপ টিপুর দুই পুত্রকে ইংরেজের আশ্রয়ে প্রেরণ করা হয় । টিপুর ছেড়ে দেওয়া রাজ্যাংশের কিছুটা মারাঠা ও নিজামকে দেওয়া হয় । এই সন্ধির ফলে মহীশূর যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ ভারতে মহীশুরের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় ।  

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসানে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কর্নওয়ালিশ সম্পূর্ণ মহীশূর রাজ্য গ্রাস না করার ফলে কোনো কোনো ইংরেজ ঐতিহাসিক বিরূপ সমালোচনা করেছেন । এঁদের মতে , টিপুর রাজ্যকে জিইয়ে রেখে কর্নওয়ালিশ অনর্থক শত্রুকে বাঁচার ও পরবর্তী কালে বৃহত্তর যুদ্ধের কারণ সৃষ্টি করেছিলেন । কিন্তু এ মন্তব্য যুক্তিযুক্ত নয় । কারণ কর্নওয়ালিশ পরিস্থিতি অনুযায়ী এগিয়েছিলেন । মহীশূর রাজ্য নিশ্চিহ্ন করলে পিটের ভারত শাসন আইন ভঙ্গ করা হত । তা ছাড়া নিজাম ও মারাঠা আরও রাজ্যাংশ এবং অর্থ দাবি করত । কর্নওয়ালিশ নিজেই মন্তব্য করেছেন যে , “ এই যুদ্ধ দ্বারা আমরা আমাদের মিত্রবর্গকে অধিক শক্তিশালী হবার সুযোগ না দিয়েই শত্রুকে পঙ্গু করেছি । ” প্রকৃতই চতুর কর্নওয়ালিশ মারাঠা বা নিজামকে বিশেষ লাভবান হতে না – দিয়েই তাদের সাহায্যে টিপুকে দুর্বল করে দিতে পেরেছিলেন । 

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের গুরুত্ব 

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ‘ দ্বারা টিপুকে দুর্বল করে দিলেও তাঁকে স্তব্ধ করা সম্ভব ছিল না । অসমসাহসী টিপু আবার নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চয়ে সচেষ্ট হন । ফ্রান্স , কাবুল , মরিশাস প্রভৃতি দেশে সাহায্য চেয়ে টিপু দূত প্রেরণ করেন । মরিশাস থেকে বহু স্বেচ্ছাসেবক মহীশূরে আগমন করে । প্রজাতন্ত্রী ফরাসি সরকারের মিত্রতার সম্মান স্বরূপ টিপু শ্রীরঙ্গপত্তমে ‘ স্বাধীনতার স্মারক ‘ ( Tree of Liberty ) স্থাপন করেন । টিপু স্বয়ং ফ্রান্সের জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য পদ গ্রহণ করেন । 

error: Content is protected !!