ইতিহাস

পিটের ভারত শাসন আইন

Contents

পিটের ভারত শাসন আইন

রেগুলেটিং অ্যাক্ট’ জারির অব্যবহিত পরেই ভারতবর্ষে কোম্পানির ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে । বস্তুত এদেশে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোম্পানির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ‘ রেগুলেটিং অ্যাক্ট ’ জারি করা হলেও , অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্য এই আইন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয় । রেগুলেটিং আইন দীর্ঘ এগারো বছর কার্যকরী ছিল ।  

এই সময়ে গভর্নর জেনারেল , কাউন্সিল সুপ্রিম কোর্ট এবং বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির পারস্পরিক সম্পর্ক ও কর্তৃত্বের প্রশ্নে নানা জটিলতার উদ্ভব ঘটতে থাকে । তাই বিভিন্ন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ নতুন আইন প্রবর্তনের জন্য দাবি উত্থাপন করতে থাকেন । সেই সময় আমেরিকার উপনিবেশগুলির সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ ইংল্যান্ডের রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে । ভারত থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে এই চাপ কিছুটা হালকা করার দিকে ইংরেজ রাষ্ট্র নেতারা মনোযোগী হন । অথচ কোম্পানির আর্থিক ব্যবস্থাও তখন সচ্ছল ছিল না ।  

কোম্পানির শাসন ব্যবস্থাকে মার্জিত করার জন্য ডান্ডাস ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন , কিন্তু তা গৃহীত হয়নি । পরের বছর বিখ্যাত বাগ্মী জেমস ফক্স আর একটি প্রস্তাব আনেন । বহু বিতর্কের পর তা কমন্স সভায় গৃহীত হলেও রাজা তৃতীয় জর্জের বিরোধিতার ফলে লর্ড সভা তা প্রত্যাখ্যান করে । অতঃপর ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী পিট এই বিষয়ে একটি আইনের প্রস্তাব করেন এবং তা গৃহীত হয় । পিট এই আইন পাশ করেছিলেন বলে এটি ‘ পিটের ভারত শাসন আইন ‘ নামে খ্যাত ।

পিটের ভারত শাসন আইন এর শর্ত

পিটের আইন অনুযায়ী-

( ১ ) ব্রিটিশ অর্থ সচিব , একজন রাষ্ট্র সচিব এবং ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক মনোনীত প্রিভি কাউন্সিলের চারজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত ‘ বোর্ড অব কন্ট্রোল ’ নামক একটি সভার উপর কোম্পানির ভারত শাসন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় । ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকেই এই সভার সভাপতি নিযুক্ত করায় ব্যবস্থা করা হয় ।

( ২ ) কোম্পানির তিনজন ডিরেক্টরকে নিয়ে একটি ‘ সিক্রেট কমিটি ‘ ( Secret Committee ) গঠিত হয় । এর কাজ ছিল ভারতে কর্মরত কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে বোর্ড অব কন্ট্রোলের নির্দেশ আদান প্রদান করা ।

( ৩ ) বোর্ড অব কন্ট্রোল এবং সিক্রেট কমিটির যুগ্ম সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা বাতিল করার ক্ষমতা থেকে ‘ অংশীদার সভা’কে বঞ্চিত করা হয় ।

( ৪ ) গভর্নর জেনারেল একজন প্রধান সেনাপতি ও অপর দুজন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিলের সাহায্যে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন স্থির হয় ।

( ৫ ) মাদ্রাজ ও বোম্বাই কাউন্সিল যুদ্ধ , শান্তি স্থাপন বা দেশীয় রাজ্যগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপন বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণাধীনে স্থাপিত হয় । জরুরি প্রয়োজনে গভর্নর জেনারেলকে কাউন্সিলের মতামত অগ্রাহ্য করার অধিকারও দেওয়া হয় ।

( ৬ ) কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই আইনে বলা হয় , ভারত থেকে চাকুরি শেষে প্রত্যাবর্তনের পর প্রতিটি কর্মচারীকে তার সম্পদের হিসাব দাখিল করতে হবে । অবশ্য এই ধারাটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি ।

( ৭ ) পিটের ভারত আইনের মুখবন্ধে লিপিবন্ধ করা হয় যে , “ রাজ্য জয় ও সাম্রাজ্য বিস্তার ইংরেজের নীতি  বহির্ভূত ও ব্রিটিশ জাতির মর্যাদা বিরোধী । ”

পিটের ভারত শাসন আইন এর গুরুত্ব

সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পিটের ভারত শাসন আইন যে বহুলাংশে কার্যকরী হয়েছিল , এ বিষয়ে সন্দেহ নেই । এই আইনে রেগুলেটিং আইনের অসম্পূর্ণতা দূর করার প্রয়াস ছিল । গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির উপর কলিকাতা কাউন্সিলের কর্তৃত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে পিটের আইন কোম্পানির শাসনকে অনেক গতিশীল করে তুলেছিল । গভর্নর জেনারেল -এর কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা একজন কম করার ফলে তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল । এই আইন দ্বারা কোম্পানির ভারতীয় সাম্রাজ্যের উপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের দাবি জোরদার হয় ।

পিটের ভারত শাসন আইনের ত্রুটি

তবে পিটের আইন দ্বারা ভারতে কোম্পানির স্বাধীন অস্তিত্ব ও কৰ্তৃত্ব কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও তা সম্পূর্ণভাবে অনাচারমুক্ত করা সম্ভব হয়নি । কারণ তখনও ডাইরেক্টরদের ক্ষমতা ছিল যথেষ্ট এবং বোর্ড অব কন্ট্রোল বাস্তবে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে ভারত শাসন ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় । 

কারণ সংবাদ ও নির্দেশ আদান  প্রদানের মাধ্যম ছিল ‘ সিক্রেট কমিটি ‘ । এটি ছিল ডাইরেক্টদের সভা । স্বভাবতই এখানে কোম্পানির স্বার্থ বিবেচনা করা হত আগে । তা ছাড়া , অর্থবলে বলীয়ান কোম্পানির কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক প্রভাব খুব কম ছিল না । তাই তাদের ক্ষুণ্ণ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না । এই আইন নতুন করে নতুন রূপে এদেশে ‘ দ্বৈত শাসন ’ চালু করেছিল বললেও ভুল হয় না । তা ছাড়া , ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা সরাসরি ভারত শাসনে জড়িত না থাকার ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা প্রত্যক্ষ দায়দায়িত্ব এড়াতে পারত ।

error: Content is protected !!