1773 রেগুলেটিং অ্যাক্ট
Contents
1773 রেগুলেটিং অ্যাক্ট
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হয়েছিল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে । ইংল্যান্ড সরকারের অনুমতি নিয়ে কোম্পানি ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেছিল । কিন্তু কর্ণাটের যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ছিল না । সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে প্রাপ্ত ‘ দেওয়ানি’র ভিত্তিতে কোম্পানির উপর এদেশের কিছু কিছু প্রশাসনিক অধিকারও লাভ হয়েছিল । সেই সঙ্গে আরও ক্ষমতালাভের উদগ্র বাসনা কোম্পানিকে এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনে প্রয়াসী করেছিল ।
পটভূমি
কোম্পানির গঠনতান্ত্রিক দুর্বলতা এবং কর্মচারীদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা কোম্পানিকে ক্রমশ জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করে । যুদ্ধজনিত ব্যয়ে কোম্পানির রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল । বোম্বাই , কলিকাতা ও মাদ্রাজে তিনটি প্রেসিডেন্সিতে কর্মরত তিনজন গভর্নরের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না । ফলে এদেশে কোম্পানির হাতে রাজনৈতিক তথ্য প্রশাসনিক ক্ষমতা আসার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ।
এই পরিস্থিতি ব্রিটিশ সরকারের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল না । কিন্তু কোম্পানির পরিচালন ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগও ছিল না । পার্লামেন্টের সদস্যরাও কোম্পানির বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য সরকারের উপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন । ইংরেজ জাতির সম্মান ও প্রতিপত্তি রক্ষার জন্যও কিছু নিয়ন্ত্রণ দরকার । এমতাবস্থায় কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের নিকট কিছু আর্থিক সুযোগ সুবিধা প্রার্থনা করে । অবস্থা বিবেচনা করে সরকার কোম্পানির উপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে । এই উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যে আইন পাশ করা হয় , সেটাই ‘ রেগুলেটিং অ্যাক্ট ‘ ( Regulating Act 1773 ) নামে খ্যাত ।
রেগুলেটিং আইন এর শর্তাবলী
রেগুলেটিং আইন প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল , যথা— কোম্পানির গঠনতন্ত্র সম্পর্কিত বা গঠনতান্ত্রিক ধারা এবং শাসন পদ্ধতি সম্পর্কিত বা প্রশাসনিক ধারা ।
গঠনতান্ত্রিক ধারা :
রেগুলেটিং আইন দ্বারা –
( ১ ) কোম্পানির অংশীদারদের সভায় ভোটদানের অধিকার ৫০০ পাউন্ড থেকে বাড়িয়ে ১০০০ পাউন্ড করা হয় । অর্থাৎ যেসব অংশীদার অন্তত এক হাজার পাউন্ড কোম্পানিতে লগ্নি করবেন , কেবল তারাই ভোটদানের অধিকারী হবেন ।
( ২ ) বোর্ড অব ডাইরেক্টর সভার সদস্য সংখ্যা হবে চব্বিশ । তাদের কার্যকালের মেয়াদ হয় চার বছর ।
( ৩ ) প্রতি বছর ডাইরেক্টরদের এক চতুর্থাংশ পদত্যাগ করবেন । তারা এক বছর পর পুনরায় পদপ্রার্থী হতে পারবেন ।
( ৪ ) ভারতবর্ষ থেকে রাজস্ব সংক্রান্ত যে সমস্ত কাগজপত্র আসবে , তা সবই ব্রিটিশ সরকারের অর্থ বিভাগকে দেখাতে হবে ।
( ৫ ) শাসন সম্পর্কে এবং সামরিক ও বেসামরিক ব্যাপার সম্পর্কিত কোম্পানির কাগজপত্র সরকারের একজন মন্ত্রীকে ( সেক্রেটারি অব স্টেট ) দেখাতে হবে ।
প্রশাসনিক ধারা :
এক আইন দ্বারা এদেশে কোম্পানির পরিচালন সম্পর্কিত বেশ কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয় ।
( ১ ) কোম্পানির ভারতীয় অংশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্ব অর্পিত হয় গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের উপর ।
( ২ ) বাংলার গভর্নর এর পর “ গভর্নর জেনারেল ” উপাধিতে ভূষিত হন ।
( ৩ ) স্থির হয় , চারজন সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিলের সাহায্যে গভর্নর জেনারেল তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করবেন । এঁরা ডাইরেক্টর সভার সুপারিশ অনুযায়ী ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন । কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত অবশ্যই মান্য করতে হবে ।
( ৪ ) কোনো বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সমসংখ্যক ভোট হলে গভর্নর জেনারেল সভাপতি হিসেবে একটি ‘ অতিরিক্ত ভোট ’ ( Casting Vote ) দিতে পারবেন । এই আইনবলে প্রথম চারজন কাউন্সিল-সদস্য মনোনীত হলেন ক্ল্যাভারিং , মনসন , বারওয়েল এবং ফিলিপ ফ্রান্সিস।
( ৫ ) ডাইরেক্টর সভা প্রয়োজনবোধে কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই কাউন্সিলদের সদস্যপদ খারিজ করতে পারবেন ।
( ৬ ) যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপনের বিষয়ে মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি বাংলার গভর্নর জেনারেল তথা কলিকাতা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য থাকবে ।
সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন
রেগুলেটিং আইন দ্বারা একজন প্রধান বিচারপতি এবং তিনজন সাধারণ বিচারপতিকে নিয়ে কলিকাতায় একটি সুপ্রিম কোর্ট স্থাপন করা হয় । স্যার এলিজা ইম্পে সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন । বিচারপতিগণ , গভর্নর জেনারেল এবং কাউন্সিল সদস্যদের বেতনও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় ।
রেগুলেটিং আইন এর ত্রুটি
ভারতে কোম্পানির শাসনকে সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত করার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল রেগুলেটিং আইন । কিন্তু এই আইনের ত্রুটি ও অস্পষ্টতা খুব কম ছিল না । ইলবার্ট এর মতে , “ সুপ্রিম কোর্টের এলাকা , সরকারের সাথে কোর্টের সম্পর্ক এবং বড়োলাট ও তাঁর কাউন্সিলের প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের আইন ছিল অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য । ”
প্রথমত , মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সির উপর কলিকাতা কাউন্সিলের কর্তৃত্ব এই আইনে খুব সুনির্দিষ্ট ছিল না । ফলে প্রায় গভর্নর জেনারেলের সাথে গভর্নরদের প্রশাসনিক অধিকার সংক্রান্ত বিরোধ সৃষ্টি হত । প্রথম ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধ ও দ্বিতীয় ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধ এই বিরোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ । দুটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রেসিডেন্সিগুলি কলিকাতা কাউন্সিলের অগোচরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ।
দ্বিতীয়ত , সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে স-পারিষদ গভর্নর জেনারেলের কাজে সীমানা খুব স্পষ্টভাবে রেখায়িত হয়নি । ফলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে শুরু করে । সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে কাউন্সিলের বিচার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে । কিছু কিছু দেওয়ানি মামলা সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করে । ফলে দেওয়ানি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ঘটে ।
তৃতীয়ত , গভর্নর জেনারেল তাঁর কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন । ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য গভর্নর জেনারেলের মতের বিরুদ্ধে গেলেই প্রশাসনিক অচলাবস্থার সম্ভাবনা দেখা দেয় । হেস্টিংসকে দীর্ঘ ছ’বছর পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে লড়াই চালাতে হয়েছে । তাঁদের মতের বিরুদ্ধেও তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে । এক্ষেত্রে হয়তো সিদ্ধান্তের গুণগত উৎকর্ষ ( Qualitative ) সাধিত হত , কিন্তু শাসনগত ( Administrative ) দুর্বলতা এড়ানো যেত না ।
এই কারণেই বাউটেন ( Bouten Rouse ) বলেছেন , “ এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ; কিন্তু এর পরিকল্পনা ছিল ত্রুটিপূর্ণ । বস্তুত এই আইন দ্বারা ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির উপর সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব পেল না , কোম্পানির পরিচালনা সভা তার চাকুরিয়াদের উপর সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব পেল না , গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের উপর সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব পেল না , আর কলকাতা প্রেসিডেন্সি মাদ্রাজ ও বোম্বাই -এর উপর সুনির্দিষ্ট কর্তৃত্ব পেল না ” ।
রেগুলেটিং আইন এর গুরুত্ব
অবশ্য উপরিলিখিত ত্রুটি সমূহ সত্ত্বেও ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসে এই আইন গুরুত্বপূর্ণ ছিল । কারণ –
( ১ ) এটিই ছিল কোম্পানি শাসিত ভারতের জন্য প্রথম লিখিত এবং পার্লামেন্ট অনুমোদিত শাসনতন্ত্র ।
( ২ ) কোম্পানির অসম্পূর্ণতা দূর করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে চিন্তিত বা ভারতের বিষয়ে তারা যে সচেতন , তা এই আইন দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল ।
( ৩ ) রেগুলেটিং আইন গভর্নরের একক শাসন ক্ষমতার পরিবর্তে গোষ্ঠী শাসনের সূচনা করেছিল ।