ইতিহাস

নবাব আলিবর্দি খান

নবাব আলিবর্দি খান

আলিবর্দি খাঁ’র আসল নাম ছিল মির্জা মহম্মদ আলি । তাঁর পিতা মির্জা মহম্মদ ছিলেন ঔরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহের কর্মচারী । অসম সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তিনি দ্রুত রাজনীতিতে উন্নতি করেন । ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে হন রাজমহলের ফৌজদার হন । নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে বিহারের নায়েব নাজিম পদে ( ১৭৩৩ খ্রিঃ ) উত্তীর্ণ হলে বাংলার রাজনীতিতে তাঁর কর্তৃত্ব দৃঢ় হয় ।  

নবাব সরফরাজ খাঁ -এর অপদার্থতা এবং নাদির শাহ কর্তৃক ভারত আক্রমণের ফলে দিল্লির বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে তিনি বাংলার মসনদ দখলের পরিকল্পনা করেন । আলিবর্দি খাঁ ছিলেন সুদক্ষ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসক । বাংলার মসনদে তার যে আইনগত অধিকার ছিল না , এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন । তাই জোরপূর্বক মসনদ দখল করেই তিনি তার অবস্থানকে আইনানুগ করতে যত্নবান হন । দিল্লির মুঘল বাদশাহের প্রতি অনুগত্য জানিয়ে এবং প্রচুর নজরানা দিয়ে তিনি বাদশাহের স্বীকৃতি আদায় করেন ।

মারাঠা আক্রমণ রোধ

আলিবর্দির শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল মারাঠাদের পুনঃপুন আক্রমণ । ১৭৪২ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে মারাঠারা প্রায় প্রতি বছরেই উড়িষ্যার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে আক্রমণ ও নির্বিচার হত্যা , লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযোগ চালাতে থাকে । মারাঠা বর্গিদের আক্রমণে বাংলার জনজীবন ও ধনসম্পদের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ।  

ভাস্কর পণ্ডিত , রঘুজী ভোঁসলে প্রমুখের নেতৃত্বে সংগঠিত মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আলিবর্দি সদাই সচেষ্ট ছিলেন । কিন্তু মারাঠাদের আক্রমণ ছিল আকস্মিক এবং গেরিলা পদ্ধতি নির্ভর । তাই নবাব বাহিনী তাদের মোকাবিলা করতে প্রায়ই ব্যর্থ হত । এমতাবস্থায় আলিবর্দি মারাঠাদের সাথে সন্ধির প্রস্তাব করেন । ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের সাথে আলিবর্দির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এই চুক্তির শর্তানুযায়ী আলিবর্দি মারাঠাদের বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা ‘ চৌথ ’ হিসেবে দিতে রাজি হন । উড়িষ্যায় রঘুজি ভোঁসলের প্রভুত্ব স্বীকৃত হয় । পরিবর্তে রঘুজী বাংলা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেন ।  

বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারাঠা আক্রমণের প্রভাব ছিল যথেষ্ট । মারাঠাদের বেপরোয়া আক্রমণ ও লুঠতরাজ , হত্যা , অগ্নি সংযোগ প্রভৃতির ফলে বহু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশান্তরে পালিয়ে গিয়েছিল । ফলে কৃষি ব্যবস্থা দারুণভাবে মার খেয়েছিল । বহু জমি অনাবাদি পড়ে থাকার ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল । দেখা দিয়েছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্যাভাব । আবার এইসব গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষই কুটির শিল্পে নিয়োজিত থাকত । তারা গৃহচ্যুত ও দেশত্যাগী হবার ফলে শিল্পে উৎপাদনও ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছিল । এর ফলে কেবল উৎপাদক শ্রেণি নয় , দেশীয় ও ইউরোপীয় বণিকদের ব্যবসাও ব্যাহত হয়েছিল । 

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই অস্থিরতা আফগান বিদ্রোহীদের নবাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্ররোচিত করেছিল । নবাব মারাঠা ও আফগান বিরোধিতায় ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে রাজনীতির অঙ্গনে ইংরেজদের প্রবেশ সহজতর হয়েছিল ।

বিদেশি বণিকদের সাথে সম্পর্ক

বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আলিবর্দি ব্যবসা বাণিজ্যে প্রসারের পক্ষপাতী ছিলেন । ফরাসি গ্রন্থকার জিন ( Jen Law ) বলেছেন যে , “ আলিবর্দি ব্যবসায়ীদের প্রতি যথার্থই সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন । ” তাঁর ভাষায় :  ইউরোপীয় বণিকদের প্রতিও তাঁর কোনো বিদ্বেষভাব ছিল না । ইউরোপীয়দের ব্যাপারে নবাব না-হস্তক্ষেপ নীতি অনুসরণ করতেন । এদের সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি ছিল বাস্তববাদী । ইউরোপীয় বণিকদের আলিবর্দি মৌমাছির সাথে তুলনা করে বলতেন যে , “ এরা শান্ত থাকলে মধু প্রদান করে , কিন্তু এদের অসন্তুষ্ট করলে হুলের জ্বালায় মৃত্যু ঘটাতেও দ্বিধা করে না ”।

তবে বিদেশি বণিকদের তিনি কখনোই সীমারেখা অতিক্রম করতে দিতেন না । ইংরেজগণ একবার মারাঠাদের পক্ষ অবলম্বন করেছিল বলে ( ১৭৫২ খ্রিঃ ) আলিবর্দি তাদের কাছ থেকে জরিমানা বাবদ প্রচুর অর্থ আদায় করেছিলেন । মারাঠা আক্রমণের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করলে আলিবর্দি খুব কঠোর ভাষায় তাদের নিরস্ত্র হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন ।

আসলে মারাঠা আক্রমণজনিত সমস্যায় বিব্রত আলিবর্দি যথাযথ কারণেই নৌবলে বলীয়ান ইউরোপীয় বণিকদের শত্রু করে তুলতে চাননি । তাঁর কোনো কোনো পরামর্শদাতা বিদেশি বণিকদের ব্যাপারে আরও কঠোর হতে পরামর্শ দিলে আলিবর্দি তাদের বলেছিলেন যে , “ স্থলে আগুন নেভানোই কঠিন কাজ , জলে আগুন লাগলে কে তা নেভাবে ’?

মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ এবং বিদেশি বণিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রতিও আলিবর্দি যত্নবান ছিলেন । মারাঠা আক্রমণে বিধ্বস্ত গ্রামগুলির পুনর্গঠন , কৃষকদের আর্থিক সহায়তা দান প্রভৃতি কাজের দ্বারা তিনি জনগণের প্রশংসা অর্জন করেন । ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যু মুখে পতিত হন ।

সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে , আলিবর্দি শাসক হিসেবে ছিলেন দক্ষ ও প্রজানুরঞ্জক । মারাঠা বর্গি আক্রমণের অভিশাপ থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তার উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয় । কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতা ও যোগ্যতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে পেরেছিলেন । ইংরেজের সাথে তিনি তেমন সংঘর্ষে লিপ্ত হননি বলে কেউ কেউ তার সমালোচনা করেন । কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতির বিচারে তাঁর কর্মধারা অযৌক্তিক ছিল না ।

error: Content is protected !!