মুঘল যুগের সাহিত্য
মুঘল যুগের সাহিত্য
মুঘল যুগে কাব্য ও সাহিত্যের বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল । সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা , বৈদেশিক আক্রমণজনিত অস্থিরতার অবসান ও আর্থিক সমৃদ্ধি মুঘল যুগে সাহিত্য সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল ।
মুঘল সম্রাটগণ ব্যক্তিগতভাবে সহিত্য রচনায় আগ্রহী ছিলেন । তাঁদের উদ্যোগে ফারসি ও হিন্দিতে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল । বাবর ও জাহাঙ্গীর স্বয়ং ছিলেন সুলেখক । বাবর রচিত ‘ আত্মচরিত ’ সে যুগের একটি মূল্যবান গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয় । এল্ফিন্স্টোন এর মতে , “ বাবরের আত্মচরিত হল এশিয়ার নির্ভরযোগ্য ইতিহাস । ” বেভারিজের মতে , “ বাবরের আত্মচরিত সব যুগের উপযোগী একটি গ্রন্থ । ” জাহাঙ্গীর রচিত ‘ তুজুক ই জাহাঙ্গীর‘ও আর একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় ।
মুঘল সম্রাটদের প্রত্যক্ষ উৎসাহে সে যুগে যে বিপুল সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি হয়েছিল , তা অবশ্যই প্রশংসনীয় । তখন মুঘল দরবারে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত বিরাজ করতেন । তাঁদের অসংখ্য সাহিত্য সৃষ্টি থেকে সে যুগের বহু ঘটনা জানা যায় । জৌহর রচিত ‘তাজকিরাত-উল-ওয়াকিয়াত‘ , আবুল ফজল রচিত ‘ আইন ই আকবরী ’ ও ‘ আকবরনামা ‘ , বদাউনি রচিত ‘ মুন্তাখাব–উল–তারিখ‘ , খাজা নিযামউদ্দিন আহমদ রচিত ‘ তবকাত ই আকবরী ’ আব্দুল হামিদ লাহোরী রচিত ‘ পাদশাহনামা ‘ , এনায়েৎ খাঁ রচিত ‘ শাহাজাহাননামা ’ , মহম্মদ সাকি রচিত ‘ মসিরে আলমগিরি ’ প্রভৃতি ছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ।
মুঘল যুগে অনুবাদ সাহিত্যও ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ । সংস্কৃত , আরবি , গ্রিক প্রভৃতি ভাষায় রচিত বহু কাব্যগ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয়েছিল । রামায়ণের ফারসি অনুবাদ করেন বদাউনি । ফৈজীকৃত মহাভারতের অনুবাদ গ্রন্থ ‘রজমনামা ’ সে যুগের একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ । এ ছাড়া মহম্মদ শাহাবাদী , ফৈজী ও হাজি ইব্রাহিম যথাক্রমে ‘ কাশ্মীরের ইতিহাস ’ , ‘ লীলাবতী ’ ও ‘ অথর্ববেদ ‘ ফারসিতে অনুবাদ করেন ।
মুঘল আমলে বহু উন্নত হিন্দি সাহিত্য রচিত হয় । এগুলির মধ্যে তুলসীদাস বিরচিত ‘ রামচরিত মানস ’ অমূল্য সম্পদরূপে আজও সমাদৃত । লক্ষ লক্ষ নরনারীর জীবনবোধ ও নৈতিক আদর্শ এই গ্রন্থকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে । এটি নীতিবোধ , দর্শন ও জীবনবোধের এক অপূর্ব সংকলন । তুলসীদাসের প্রতিভার প্রশংসা করে জর্জ গ্রিয়ারসন বলেছেন , “ One of the greatest reformers and one of the greatest poets that India has ever produced . ” এ ছাড়া সুরদাস রচিত ‘ সুরসাগর ’ , কবিরের ‘ দোঁহা সমূহ ’ , মহম্মদ জায়সী রচিত ‘ পদ্মাবৎ ‘ , সাধিকা মীরাবাঈ রচিত ভজন গুলিও হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধিশালী করেছিল ।
মুঘল যুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার ও সাহিত্যের উন্নতিও ছিল উল্লেখযোগ্য । এ যুগে বাংলাদেশে ‘ বৈষ্ণব সাহিত্য ’ ও ‘ মঙ্গলকাব্যের ‘ ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল । বৈষ্ণব সাহিত্যগুলির মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘ চৈতন্যচরিতামৃত ’ , বৃন্দাবন দাস রচিত ‘চৈতন্য ভাগবত’ এবং জয়ানন্দ বিরচিত ‘ চৈতন্যমঙ্গল ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য রচনা । মঙ্গলকাব্য -গুলির মধ্যে মুকুন্দরামের ‘ চণ্ডীমঙ্গল ‘ , ভারতচন্দ্রের ‘ অন্নদামঙ্গল ’ ছিল উল্লেখযোগ্য রচনা । এ ছাড়া মুঘল যুগে কাশীরাম দাস ‘ মহাভারতের ’ বঙ্গানুবাদ করেন । ওড়িয়া ভাষায় রচিত ভক্তিকাব্যগুলিও যথেষ্ট খ্যাতির অধিকারী । ওড়িয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে দিনকর দাস , বলদেব , অভিমন্যু সামন্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য । রাজস্থানী , গুজরাটি , মারাঠি , মালায়লম প্রভৃতি ভাষাতেও মুঘলযুগে বহু উন্নত সাহিত্য রচিত হয়ে ভারতের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিল ।