শাহজাহানের রাজত্বকাল কে কি সুবর্ণ যুগ বলা যায়
শাহজাহানের রাজত্বকাল কে কি সুবর্ণ যুগ বলা যায়
নানা কারণে ভারত ইতিহাসে শাহজাহানের রাজত্বকালে উজ্জ্বলতায় ভরা ছিল । সেই কারণে বহু ঐতিহাসিক শাহজাহানের রাজত্বকালকে ‘ মুঘল সাম্রাজ্যের সুবর্ণ যুগ ‘ বলে অভিহিত করেছেন ।
সপক্ষে যুক্তি
রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শাহজাহানের রাজত্বকালে যে অভূতপূর্ব সংহতি ও উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছিল , তা বিচারে তাঁর রাজত্বকালকে ‘ মুঘল-ভারতের চরম উৎকর্ষের যুগ ’ বলে অভিহিত করা যায় । আকবরের আমলে যে মুঘল সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয়েছিল , শাহজাহানের আমলেও তা অব্যাহত ছিল । এমনকি ভারতের সীমা অতিক্রম করে তা মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত হয়েছিল । দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলির উপরে মুঘল প্রভুত্ব কার্যকরীরূপে স্থাপিত হয়েছিল ।
দ্বিতীয়ত , শাহ্জাহানের রাজত্বকালে কোনো বৈদেশিক আক্রমণ ঘটেনি বা অভ্যন্তরীণ কোনো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি । ফলে তাঁর পুত্রদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের পূর্ববর্তী সময়ে দেশে যে শান্তিশৃঙ্খলার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল , তা দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করেছিল । ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড শাহজাহানের রাজত্বকালকে ‘ কৃষিক্ষেত্রে শান্তির যুগ ’ বলে অভিহিত করেছেন । আব্দুল হামিদ লাহোরীর ভাষ্য থেকে জানা যায় যে , শাহজাহান কৃষি-খাল খননের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন । রাভী ও যমুনা নদী থেকে জলসেচের ব্যবস্থা করার ফলে কৃষির ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল । শাহজাহানের আমলে রাজস্ব আয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল । তিনিও জমি জরিপ করে ফলন অনুসারে রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন । পরন্তু মুর্শিদকুলি খাঁ’র সুযোগ্য পরিচালনায় দাক্ষিণাত্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল । তা ছাড়া ওই সময়ে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল । বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সুরাট বন্দর তখন বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে । এইভাবে কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতির মাধ্যমে শাহজাহান দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হন ।
তৃতীয়ত , তিনি যে প্রজাদরদী শাসক ছিলেন , তার প্রমাণ পাওয়া যায় দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে গৃহীত সাহায্যমূলক কর্মসূচি থেকে । দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনগণের মঙ্গলের জন্য তিনি বহু সরকারি লঙ্গরখানা খোলার নির্দেশ দেন ; এবং আর্থিক সাহায্য দানেরও ব্যবস্থা করেন । পিটার মাণ্ডি দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের প্রতি সম্রাটের উদারতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ।
চতুর্থত , শাহজাহানের রাজত্বকালে জনগণের ধনমানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল সুনিশ্চিত । পর্যটক মানুচি ও টেভার্নিয়ে শাহজাহানের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থার উল্লেখ করে বলেছেন যে , জনসাধারণের সুখশান্তি ও ধনপ্রাণের নিরাপত্তার প্রতি সম্রাট সর্বদা সজাগ থাকতেন । সড়কপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সাথে সাথে তিনি পথচারীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও বিধান করেন । এজন্য তিনি বহু সরাইখানা নির্মাণ করেন ।
পঞ্চমত , শাহজাহানের আমলে বিচার ব্যবস্থা ছিল উন্নত ও নিরপেক্ষ । বিচারের ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ করা হত না । রাহ বাহারমল তাঁর ‘ লুবাব উৎ তাওয়ারিখ ‘ গ্রন্থে এবং ইতালীয় পর্যটক মানুচি তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে শাহজাহানের সৎ ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন ।
ষষ্ঠত , শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্য ও শিল্পকলার চরমতম উৎকর্ষ সাধিত হয় । তাঁর আমলে নির্মিত সৌধগুলিতে লাল পাথরের পরিবর্তে মার্বেল পাথর ব্যবহৃত হয় । এই সৌধগুলি নির্মিত হয়েছিল , ইন্দো-পারসিক রীতির সংমিশ্রণে । তার সময়ে নির্মিত ‘ দেওয়ান ই আম ’ , ‘ দেওয়ান ই খাস ’ , ‘ জামি মসজিদ ’ , ‘ মতি মসজিদ ’ , ‘ নওলাখা মসজিদ ’ , ‘ তাজমহল ‘ প্রভৃতি সৌধগুলি স্থাপত্য সৌন্দর্যের নিদর্শন স্বরূপ আজও বিস্ময় উদ্রেক করে । এগুলির মধ্যে তাজমহলের নির্মাণশৈলী ও শোভা কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে । এ ছাড়া বহু অর্থব্যয়ে নির্মিত ‘ ময়ূর সিংহাসন ‘ শাহজাহানের সৌন্দর্য পিপাসার সাক্ষ্য বহন করে ।
সপ্তমত , শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় সে যুগে শিক্ষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছিল । তিনি ছিলেন বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী । আরবি , ফারসি ও হিন্দি ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা ছিল । কবি জগন্নাথ পণ্ডিত , সাহিত্যিক চিন্তামণি , বারাণসীদাস , প্রবোধ চন্দ্রোদয় , আব্দুল হামিদ লাহোরী , আব্দুল কাশিম প্রভৃতি বহু হিন্দু – মুসলিম পণ্ডিত শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন । সেই সময়ে রামায়ণ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয় । বিদ্যাপ্রসারের জন্য তিনি বহু বিদ্যালয় নির্মাণ করেন । এগুলির মধ্যে ‘ দার উল বাকা ’ মাদ্রাসা ও দিল্লির ‘ রাজ কলেজ ‘ উল্লেখযোগ্য ।
এই সমস্ত কারণে লেনপুল , হান্টার প্রমুখ আধুনিক ঐতিহাসিক ও বিভিন্ন পর্যটক শাহ্জাহানের রাজত্বকালকে ‘ মুঘল আমলের সুবর্ণ যুগ ‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
বিপক্ষে যুক্তি
কিন্তু শাহজাহানের রাজত্বকালের এই আপাতদৃষ্ট উজ্জ্বল চিত্র গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে অনেক ফ্যাকাসে মনে হবে । প্রথমত , সাম্রাজ্যের প্রসারক হিসেবে শাহজাহান ছিলেন ব্যর্থ । কারণ তাঁর কোনো অভিযানই প্রকৃত অর্থে সফল ছিল না । তিনি কান্দাহারে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং দাক্ষিণাত্যে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
দ্বিতীয়ত , কৃষি ব্যবস্থার কিছু উন্নতি সাধিত হলেও সাধারণ কৃষিজীবীদের অবস্থা ভালো ছিল না । বার্নিয়ে তার বিবরণীতে কৃষকদের উপর সরকারি কর্মচারীর সীমাহীন শোষণের কথা উল্লেখ করেছেন । সরকারি দাবি মেটাতে গিয়ে জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনটুকুও কৃষকদের হাতে থাকত না ।
তৃতীয়ত , যে জায়গিরদারি ব্যবস্থা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল , তার শুরু হয়েছিল শাহ্জাহানের রাজত্বে । আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথার কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ শাহজাহান হারিয়ে ফেলেছিলেন ।
চতুর্থত , তাঁর আমলে শিল্প-স্থাপত্যের প্রাচুর্য ও চাকচিক্য সাম্রাজ্যের সামগ্রিক উন্নতির প্রমাণ নয় । সমগ্র শরীরের রক্ত মুখে সঞ্চালিত হয়ে মুখমণ্ডল যদি উজ্জ্বল দেখায় , তা যেমন সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয় , তেমনি দেশের সমস্ত সম্পদ শিল্প-স্থাপত্যে ব্যয় করাকেও সুস্থ অর্থনীতি বলা যায় না । শিল্প-স্থাপত্যে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা গিয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের উপর । পরন্তু রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়েছিল । আপাত উজ্জ্বলতার পেছনে ছিল গভীর অন্ধকার । স্মিথ বলেছেন , “ There were shadows in the picture which were ignored by the court annalists .”
পঞ্চমত , শাহজাহানের ধর্মীয় অনুদারতা সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে শিথিল করেছিল । আকবর যে ধর্মীয় উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলেন , শাহজাহান তার বিপরীত নীতি অনুসরণ করে আবার হিন্দুদের মুঘল বিরোধী করে তুলেছিলেন । তার ধর্মীয় গোঁড়ামিই ঔরঙ্গজেবের সময় চূড়ান্ত রূপ পায় ।
ষষ্ঠত , শাহজাহানের জীবিতকালেই তাঁর পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল । শাহজাহান তখন ছিলেন অসহায় দর্শকমাত্র । তার বৈষম্যমূলক ও দূরদৃষ্টিহীন আচরণই এই বিরোধের অন্যতম কারণ ।
উপরিলিখিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে , শাহজাহানের রাজত্বকালে নানা দিক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের চাকচিক্য পরিলক্ষিত হলেও , তখন দেশ হয়ে পড়েছিল অন্তঃসারশূন্য । স্বেচ্ছাচারিতা , আড়ম্বর ও বিলাস-ব্যসনের ফলে দেশের রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়েছিল ।